এতক্ষণে লক্ষ হয় ঘরে আরও দুজন লোক আছেন। একজন পুরুষ একজন মহিলা! ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললে-বহুবচন নয়, মিস্টার মুখার্জি, একবচনে বলুন। আমি ওঁকে এখানে আনতে চাইনি। এনেছেন মিসেস ব্যানার্জি। আমি এর ভেতরে নেই। সুতরাং আপনার আপত্তি না থাকলে আমি বরং বাইরে অপেক্ষা করি।
আমি তাঁর দিকে ফিরতেই ভদ্রলোক আমাকে হাত তুলে নমস্কার করেন। অলকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই তিনি বেরিয়ে যান ঘর ছেড়ে।
গৌতম!
ঘরে ক্ষণিক স্তব্ধতা। আমার মনটা ক্রমশ যেন অসাড় হয়ে আসছে। গৌতম এখানে কেন? কী বলছিল সে অলককে এতক্ষণ? আমার কথা? বেশ তো, তাহলে স্থানত্যাগ করে পালিয়ে যাবার কী আছে? অলক কি আমার কৈফিয়ত তলব করতে চায়? তাই যদি হবে তবে প্রধান সাক্ষীর তত বিচারালয়ে উপস্থিত থাকারই কথা। কিন্তু অলকের এ কী ব্যবহার! আমার বিরুদ্ধে তার যদি কোনো অভিযোগই থাকে তাহলে তা নিয়ে আলোচনা করার এই কি পরিবেশ, না সময়?
অলক একটা সিগারেট ধরায়। কাঠিটা অ্যাশট্রেতে রাখে। সেটাতে বোধহয় জল ছিল না। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে কাঠিটা। আগুনটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। তবু অ্যাশট্রের অন্ধ কোটরে কাঠিটা যে নিজেরই বারুদের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে তা অনুভব করা যায়। দেশলাই কাঠিগুলো এত মূর্খ কেন? কেন বোকার মত মাথায় তুলে রেখেছে একফোটা বারুদ? আর যদি রেখেই থাকে তাহলে তা আবার ঘষে জ্বালতে যাওয়া কেন? এখন নিজেই পুড়ে মরছে!
কী আবোলতাবোল ভাবছি?
হঠাৎ অলক বলতে শুরু করে–আজ সকালে আমরা একটা উড়ো চিঠি পেয়েছি। আমি ছিলুম না এখানে। ফিরে এসে এইমাত্র সে চিঠি পড়েছি। তাতে শ্রমিকপক্ষ থেকে আমাকে শাসানো হয়েছে যে, তাদের দাবি যদি মেনে না নিই তাহলে আমাদের কয়েকটি গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হবে। চিঠিটায় আমাদের কনফিডেন্সিয়াল ফাইলের লেটার নম্বর ও তারিখের উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের গলতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই তথ্যগুলির প্রকাশ কোম্পানির পক্ষে মর্যাদাহানিকর এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে সন্দেহটা পড়ে আমার কনফিডেনশিয়াল স্টেনো মিস রায়ের ওপর, আই মিন মিসেস্ ব্যানার্জির ওপর;–বাই-দ্য-ওয়ে, তোমাকে এঁর সঙ্গে এখনও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি আমার স্টেনো মিসেস পর্ণা ব্যানার্জি।
এবারও নমস্কার করতে ভুলে গেলাম আমি। ও হাত দুটো বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গি করল–আমার মনে হল, আসলে হাত দুটিতে যে বালা ও রিস্টওয়াচের বদলে শাঁখা ও নোয়া রয়েছে এইটেই সে হাতদুটি তুলে দেখাল। একতিলও বদলায়নি সে এ ছাড়া।
–যদিও মিস পর্ণা রায় নামে ইনি আমাদের অফিসে পরিচিত, কিন্তু আজ শ্রমিক নেতা শ্রীগৌতম ব্যানার্জি হঠাৎ দাবি করে বসেছেন এই শাঁখা-সিঁদুরহীন আমার স্টেনোটি তার ধর্মপত্নী আই মীন অধর্মপত্নী, কারণ এঁদের মতে ধর্ম জিনিসটা সমাজের পক্ষে আফিঙের নেশার মতো পরিত্যাজ্য। না কী বলেন মিসেস ব্যানার্জি?
পর্ণা সে কথায় কান দেয় না। আমার দিকে ফিরে সবিনয়ে বলতে থাকে–মাফ করবেন মিসেস্ মুখার্জি-রাত করে আপনাকে কষ্ট দিতে হল! অলকের ধারণা ও-পক্ষকে আমিই গোপন সংবাদগুলি দিয়েছি। তাই আজ ও হঠাৎ আমায় কৈফিয়ত তলব করে। আমি জানি, আমার উত্তরের মমোদ্ধার করতে পারবেনা ও;—আমার ধারণা বরাবরই আমাকে তুমি ভুল বুঝে এসেছ অলক।
ওর দিকে ফিরে এই শেষ কথাটা বলেই আবার আমার দিকে ফেরে–ও, আপনার স্বামীকে নাম ধরে ডাকছি বলে অবাক হচ্ছেন বুঝি…না, না, অধিকার-বহির্ভূত কিছু করছি না আমি। অলক আমাকে তুমি বলতে পারমিশান-আই শুড সে-বারে বারে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছে!
আবার আমাকে ছেড়ে ওকে আক্রমণ করে-নাকি মিসেস মুখার্জির সামনে আবার তোমাকে আপনি-আজ্ঞে করতে হবে? অফিসে সবার সামনে যেমন করি?
অলক গর্জে ওঠে–কী সব আবোলতাবোল বকছেন আপনি!
–ও আপনি! বুঝেছি, বুঝেছি, এইটুকু ইঙ্গিত বুঝবার মত বুদ্ধি আছে আমার! বেশ, আমিও না হয় আপনিই বলব সুনন্দা দেবীর সামনে! হ্যাঁ, যা বলছিলাম–বুঝলেন মিসেস মুখার্জি, ছাত্রজীবন থেকেই আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। সে যুগে ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলন, এ যুগে অর্থনৈতিক। সে যুগে অনেকে এসে যোগ দিয়েছিল আমার সঙ্গে, তারা বেশ গরম গরম বক্তৃতা দিত। আজকাল তারা সুযোেগ পেয়ে সরে দাঁড়িয়েছে—শুধু তাই নয়, অন্যায় যে সহে-র দল ত্যাগ করে অন্যায় যে করে-র দলে নাম লিখিয়েছে। তাতে অবশ্য আমার দুঃখ নেই। আমি একই পথে চলেছি। আপনার স্বামীর অধীনে চাকরি করার দীনতা আমাকে স্বীকার করতে হয়েছে পার্টির নির্দেশে। এ তথ্যগুলি ও পক্ষকে আমিই সরবরাহ করেছি; কারণ…
অলক চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে—ইউ ট্রেচারাস্ ওয়েঞ্চ!
পর্ণা নির্বিকারভাবে বলে—শেক্সপীয়র!
এতক্ষণে বাক্যস্ফূর্তি হয় আমার, অবাক হয়ে বলি–মানে?
পর্ণা আমার দিকে ফিরে হাসি গোপন করে বলে-কী আশ্চর্য! আপনি এ খেলা জানেন না? একে বলে কোটেশান-খেলা। এই খেলার মাধ্যমেই আমরা হাতে-হাত মিলিয়েছি যে! অলক একটা উদ্ধৃতি দেয়—আই মীন, অলকবাবু একটা উদ্ধৃতি দেন—আর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলে দিতে হয় কোথা থেকে কোটেশান দেওয়া হল। ঠিক ঠিক বলতে পারলেই হাতে হাতে পুরস্কার পাই। অবশ্য কী জাতীয় পুরস্কার তা আর নাই বললাম, অলক লজ্জা পাবে তাহলে!