আমি কোনো জবাব দিইনি। দিতে পারতুম, দিইনি। জবাবে আমি ওকে মনে করিয়ে দিতে পারতুম–বায়রনের সেই অনবদ্য উক্তিটি রেডি মানি ইজ আলাদীনস্ ল্যাম্প (নগদ টাকা আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ)। মুখে বলিনি, কারণ সেটা ব্যবহারে পরে বুঝিয়ে দেব বলে।
এর পর প্রত্যহ নিউমার্কেট থেকে আমার বাড়ি ফুল সরবরাহের ব্যবস্থা করে দিলুম।
একটা বিলাতি অর্কেস্ট্রা যেমন ঐকতানে বাজে—এ সংসারের সবকিছুই তেমনি একটা শৃঙ্খলা বজায় রেখে আমাদের দাম্পত্য-জীবনের মূল সুরটি ধরে রেখেছে। একচুল বিচ্যুতি ঘটবার উপায় নেই। যত কাজই থাক, আমাদের দাম্পত্য-জীবনের সুখ-সুবিধার ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু ঘটতে দিতুম না। রবিবার সন্ধ্যায় আমার ডায়েরিতে কোনো অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঢুকতে পারেনি। সপ্তাহান্তিক অবসরটা আমি স্ত্রীর সঙ্গে কাটাই। শহরে কোনো একটি প্রেক্ষাগৃহের সবচেয়ে সামনের অথবা সবচেয়ে পিছনের দুটি আরামদায়ক আসন আমাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গোণে। আমার আদালী রামলালকে পাঠিয়ে টিকিট কিনে রাখার দায়িত্বটা নন্দার। কী বই দেখবে তার নির্বাচনের ভার সম্পূর্ণ সুনন্দার উপর ছেড়ে দিয়েছি। প্রথম প্রথম নন্দা এ বিষয়ে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইত। কোন্ কাগজে কী। সমালোচনা বের হয়েছে, কে কী বলেছে আমাকে শোনাতে আসত। আমি ডিভিশন অফ লেবারে বিশ্বাসী। এ বিষয়ে যখন তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া আছে তখন আমি অহেতুক নাক গলাই কেন? সে যেখানে আমায় নিয়ে যাবে আমি সেইখানেই যেতে রাজি। ইবসেনের নোরার মত সে যেন না কোনোদিন বলে বসতে পারে—তাকে নিয়ে আমি পুতুল খেলা করেছি মাত্র। প্রেক্ষাগৃহের সবগুলি আসনের সামনে বসলে বুঝি থিয়েটার দেখছি—সবার পিছনে যখন বসি তখন বুঝে নিই—এ রবিবারে নন্দা আমাকে সিনেমা দেখাচ্ছে।
শুধু এই একটি বিষয়েই নয়–অনেক গুরুতর বিষয়েও আমি তাকে মতামত প্রকাশ করবার সুযোগ দিই। তার নির্দেশের ওপর অন্ধ নির্ভর করি। এই তো সেদিন কোম্পানি আমার জন্য একজন অতিরিক্ত লেডি স্টেনো স্যাংশন করল। আপনারাই বলুন, এ বিষয়ে কেউ কখনও স্ত্রীর পরামর্শ নিতে যায়? নিজেই ইন্টারভু নেয়, নিজেই নির্বাচন করে-এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সংবাদটা ধর্মপত্নীর কাছে বেমালুম চেপে যায়। আমি এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম। এবং এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমটাই আমার কাছে নিয়ম! আমি সবকটি দরখাস্ত সুনন্দাকে এনে দিলুম। অকপটে বললুম-তুমি যাকে নির্বাচন করে দেবে, আমি নির্বিচারে তাকেই গ্রহণ করব।
পাঠক! তুমি পার এতটা অনাসক্ত হতে?
আমি পারি। নন্দার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। তার অন্যায় আবদার পর্যন্ত আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি। জানি না, দরখাস্তকারিণীরা এ নিয়ে আমার বিষয়ে কী ভেবেছিল! কেউ কি স্বপ্নেও ভাবতে পারে যে, শুধুমাত্র স্ত্রীর অনুরোধেই অলক মুখার্জি সকলের ফটো চেয়ে পাঠিয়েছিল? পাঠিকা! তুমি যদি দরখাস্তকারিণী হতে, তাহলে কি বিশ্বাস করতে পারতে যে, তোমার ফটোখানি না দেখেই আর পাঁচখানা ফটোর সঙ্গে তুলে দিয়েছিলুম আমার ধর্মপত্নীর হাতে? অন্য কেউ না জানুক আমি নিজে তা জানি। আর নন্দাও জানে যে, তার একটা খেয়াল চরিতার্থ করতেই আমাকে এই আপাত-অশোভন কাজটি করতে হয়েছিল।
ফটোর বান্ডিলটা তার হাতে দিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম–এই নাও। এর থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটিকে খুঁজে বার কর এবার।
সুনন্দা সাগ্রহে ফটোর বান্ডিলটা আমার হাত থেকে নেয়। ডানলোপিলো গদির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে বাছতে থাকে ছবির গোছা। হঠাৎ একখানি ফটোতে তার দৃষ্টি আটকে গেল। ফটোখানি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে—কেমন দেখতে মেয়েটিকে?
আমি বললুম-কী বললে তুমি খুশি হও?
–সত্যি কথা বললে। মেয়েটি কি খুব সুন্দরী?
—না।
—মেয়েটি কি কুৎসিত?
–তাও না? তবে কি মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী?
-তা বলা চলে। হঠাৎ ধমক দিয়ে ওঠে সুনন্দা–কোনখানটা ওর সুন্দর দেখলে তা জানতে পারি কি?
কী বিপদ! কী বললে সুনন্দার সঙ্গে মতে মিলবে তা বুঝে উঠতে পারি না। ছবি দেখে মেয়েটিকে সত্যিই কিছু আহামরি সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে না। ছিপছিপে একহারা চেহারা। রূপসী না হলেও মুখখানি উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত। সুনন্দা আবার বলে-কই, বললে না? ওর কোনখানটা সুন্দর লাগল তোমার?
বললুম–দি বেস্ট পার্ট অব বিউটি ইজ দ্যাট হুইচ নো পিকচার ক্যান এক্সপ্রেস (সৌন্দর্যের মর্মকথা সেটাই, যেটা ছবিতে ধরা দেয় না)–
—রাসকিন বলেছেন বুঝি?
–না। বেকন।
—তা আমি তো আর বেকন-সাহেবের মতামত শুনতে চাইনি। আমি শুনতে চাই তোমার কথা। বললুম—আমার মতামতটা না জিজ্ঞাসা করাই ভালো। সৌন্দর্যের তো কোনও মাপকাঠি নেই–সুতরাং কতটা সুন্দর তা বোঝাতে গেলে তুলনামুলক শব্দ ব্যবহার করতে হয়। অন্য ছবিগুলো তো আমি দেখিনি। তা কার সঙ্গে তুলনা করব বল?
–অন্য ছবিগুলো তুমি দেখনি? শুধু এই একখানি ছবি দেখেই এত মোহিত হয়ে গেলে? কিন্তু কেন? কী দেখলে তুমি!
আমি বলি—কী আশ্চর্য! তুমি আমার কথাটা বুঝতেই চাইছ না। মোহিত হয়ে যাবার কোনো কথাই উঠছে না। এখানাও তত আমি আগে দেখিনি। তুমি এখন দেখালে, তাই দেখছি। এখন কথা হচ্ছে তুলনা করতে হলে–
বাধা দিয়ে নন্দা বলে–বেশ দেখ, সবগুলো ছবিই দেখ।
ছবির বান্ডিলটা সে ছুঁড়ে দেয় আমার দিকে। অজানা অচেনা একগুচ্ছ মেয়ে লুটিয়ে পড়ল আমার পায়ের কাছে। আমি তাসের প্যাকেটের মতো সেগুলি তুলে রেখে দিলুম টিপয়ে। দেখলাম না চোখ তুলেও। বললুম–না। আমি দেখব না। তুমি যাকে পছন্দ করে দেবে তাকেই বহাল করব আমি।