বেশ বুঝতে পারছি মাত্রাতিরিক্ত পান করা হয়ে গেছে। এ বোধ ঠিকই আছে যে, আজ রাত্রে আমার পক্ষে মাতাল হওয়া মারাত্মক; মাথা ঠিক রাখা দরকার। কিন্তু কিছুতেই যেন নিজেকে সামলাতে পারি না। একটানা ঘড়ির টিকটিক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই বিশ্বচরাচরে। মাঝে মাঝে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে দ্রুতগামী মালবোঝাই লরী চলেছে। ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়েছি। রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো যাবার সময় যখন বাঁক ঘুরছে তখন হেডলাইটের ক্ষণিক আলোয় মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে ঘরের ভেতরটা—খোলা জানলা দিয়ে আসছে ওদের আলোর আক্রোশ!
পর্ণার সঙ্গে বোঝাপড়ার আজকেই শেষ!
পর্ণা যদি অলক মুখার্জির চরম সর্বনাশ করে থাকে তাহলে পর্ণা রায়কেও আজ রাত্রে কেউ চরম সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।
ক্রমশ রাত বাড়ছে।
মাঝে একবার এখানকার বেয়ারাটা খবর নিতে এল নৈশ আহার দিয়ে যাবে কিনা। আমার কিন্তু খাবার চিন্তা মাথায় উঠেছে তখন।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ গাড়ি ফিরে আসার আওয়াজ পেলুম।
উত্তেজনায় স্থির থাকতে পারি না। বেরিয়ে আসি বাইরের বারান্দায়। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।
যোগীন্দর সিং নেমে এল গাড়ি থেকে। আর কেউ আসেনি।
সেলাম করে একটি খাম এগিয়ে দিল সে।
ছোট্ট চিঠি। পর্ণা লিখেছে–মধ্যরাত্রে বসের বাগানবাড়িতে যাবার কথা নেই তার চাকরির শর্তে। তাকে যেন আমি ক্ষমা করি।কাল সকালে সে আসছে। গাড়ি পাঠাবার দরকার নেই। সকাল নটার মধ্যে সে ট্রেনেই এসে পড়বে। আমি যেন তার জন্য এখানেই অপেক্ষা করি।
আবার স্বীকার করতে হল অত্যন্ত ধূর্ত মেয়ে ঐ পর্ণা রায়!
০৮. সমস্তটা দিন
সমস্তটা দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল। অলক আজকেও ফিরবে না নাকি? কিন্তু পর্ণাকে টেলিফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে কেন? দুজনে কী করছে ওরা?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। ক্রমে সন্ধ্যা। তারপর আবার ঘনিয়ে এল রাত। এ কী কাণ্ড, অলক কি আজকের রাতটাও বাইরে কাটাবে? সত্যিই বর্ধমানে গেছে তো? আর কে কে আছে সেখানে? হঠাৎ ঝঝন্ করে বেজে ওঠে টেলিফোন। উঠে গিয়ে ধরলাম। হ্যাঁ, অলকই ফোন করছে। না, ট্রাঙ্ক লাইন নয়। অফিস থেকে।
—কে, সুনন্দা? হ্যাঁ, অলক বলছি। শোন, তুমি এখনই চলে এস এখানে। হা হা, অফিসে! জরুরি দরকার। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।
অবাক হয়ে বলে–কী বলছ যা তা? আমি অফিসে যাব কী? তুমি বাড়ি আসবে না? কোথা থেকে বলছ তুমি?
—অফিস থেকেই বলছি। তোমার সঙ্গে জরুরি দরকার। গাড়ি যাচ্ছে। রামলালও যাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
আমি আর কিছু বলার আগেই ও লাইন কেটে দেয়। এর মানে কী? অন্য কেউ এ-ভাবে ফোনে ডাকলে মনে হত কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে হয়তো। কিন্তু ওই তো কথা বলল। তাহলে ওর কিছু হয়নি। এমনভাবে আমাকে অফিস ডেকে নিয়ে যাবার মানে? আমি কি কখনও ওর অফিসে গিয়েছি, যে এভাবে মাঝরাতে আমাকে সেখানে ডেকে পাঠাচ্ছে?
গৌতমের ব্যাপারটা কি ও জানতে পেরেছে? কোন সূত্রে? নমিতা বা কুমুদবাবু কি বলেছেন? বেশ, তাই যদি হবে, তাহলে সে ব্যাপারে ফয়শালা করবার রঙ্গমঞ্চ তার অফিস নয়। বাড়িতে এসে সে কৈফিয়ত দাবি করতে পারত।
ভাবতে ভাবতে গাড়ি এসে দাঁড়ায় পোর্টিকোর সামনে।
কাপড়টা পাল্টে নেমে আসি। রামলালকে জিজ্ঞাসা করি–কী হয়েছে রামলাল? সাহেব আমাকে ডাকছেন কেন?
রামলাল প্রত্যাশিত জবাবই দেয়। সে তা জানবে কেমন করে? ড্রাইভারকে প্রশ্ন করে জানতে পারি, বর্ধমান থেকে গাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যায়। তারপর থেকে কী যেন মিটিং হচ্ছে বন্ধ ঘরের ভেতর। কারখানার সামনে এসে পৌঁছাল গাড়ি। দারোয়ান আভূমি নত হয়ে প্রণাম জানায়। রাইফেলধারী প্রহরী পাহারা দিচ্ছে গেটে। কারখানার বাইরের দেওয়ালে ধর্মঘটি শ্রমিকদের হাতে-লেখা পোস্টার। সাদা কাগজের ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা পোস্টারগুলো দেখে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল যেন। একেই কি বলে দেওয়ালের লিখন? মনে পড়ে গেল কলেজের দেওয়ালে একদিন ঐ কথাই নিজে হাতে লিখেছিলাম আমি পোস্টারে। গৌতমরা রাতারাতি সেগুলি এঁটে দিয়ে এসেছিল কলেজের প্রাচীরে। সেই ভুলে যাওয়া বেয়াল্লিশ সালে। ঐ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে–।
অলকের অফিসঘরে ইতিপূর্বে কখনও আসিনি। মস্ত বড় ঘর, মাঝখানে সেগুনকাঠের বিরাট পালিশ করা টেবিল। কাগজ-চাপা থেকে প্রত্যেকটি জিনিস ঝকঝক করছে ফুরেসেন্ট আলোয়। সবই উজ্জ্বল–শুধু মাঝখানে বসে আছে অলক-যেন বাজে পোড়া বটগাছ! সারাদিন বোধহয় স্নান হয়নি, রুক্ষ চুলগুলো উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। টাইয়ের বাঁধনটা আলগা করা। এত হাওয়ার নীচেও লক্ষ করলাম ওর কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অলক আজ দাড়ি কামায়নি! পাশ থেকে দুজন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাত তুলে নমস্কার করলেন আমাকে। ঠিক মনে নেই, বোধহয় প্রতিনমস্কার করতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি। অথবা হয়তো যন্ত্রচালিতের মতো হাত দুটো উঠে এসেছিল বুকের কাছে। ওঁরা ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। বিহ্বলভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। পার্কার কলমটার উল্টো দিক দিয়ে অলক সম্মুখস্থ একটা চেয়ারে নির্দেশ করে। আমি বসি।
মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে অলক বলে ওঠে–এ অসময়ে তোমাকে ডেকে আনার কারণটা জানতে নিশ্চয় খুব কৌতূহল হচ্ছে তোমার। অবাক হওয়া তোমার পক্ষে স্বাভাবিক, আমিও কম অবাক হইনি।
তোমাকে আমি এখানে ডেকে আনিনি–এনেছেন এঁরা–