আমি হেসে বলি, ব্যাপারটা তো বুঝলাম না। আমাদের কারখানায় য়ুনিয়ান থাকলে তারা অন্য কোথাও অ্যাফিলিয়েশন চাইতে পারত—কিন্তু যার মাথা নেই সে কেন মাথাব্যথার ওষুধ খুঁজতে আসবে?
গণি বলেন, ওরা মাথাব্যথার ওষুধ খুঁজতে আমাদের কাছে আসেনি, মাথা খুঁজতেই এসেছে। ওদের ঘাড়ের ওপর যে মাথা আছে এটা আপনাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতেই আমাদের সাহায্য চাইছে।
বাধা দিয়ে বলি, এ সব আলোচনা আমি আপনাদের সঙ্গে করতে চাই না। আমার কারখানায় য়ুনিয়ান নেই বটে, কিন্তু তাদের মুখপাত্রদের ডেলিগেশনের বক্তব্য আমি শুনেছি। তাদের আর কোনো বক্তব্য থাকলে তারাই জানাবে। আপনাদের কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।
গণি একটু হেসে বলেন, মিস্টার মুখার্জি, তবু আমাদের বক্তব্যটা আপনাকে শুনতে হবে। তাতে আপনারই মঙ্গল।
বিরক্ত হয়ে বলি, প্লীজ মিস্টার গণি, আপনারা এবার উঠুন। আপনাদের প্রতি দুর্ব্যবহার আমি করতে চাই না, কিন্তু আমাকে বাধ্য করবেন না আপনারা। আমি এখন বিশ্রাম করতে চাই।
মিস্টার গণি বলেন, যে জন্যে আপনি বর্ধমানে ছুটে এসেছেন আমরা কিন্তু সেই বম্বে ডীলটার বিষয়েই আলোচনা করতে এসেছি!
আমার মুখে কথা ফোটেনি।
গণি দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, বলেন—কী বলেন? বিশ্রাম করবেন, না আলোচনা করবেন?
মনস্থির করে নিয়ে একটু বিস্ময়ের ভান করে বলি, কোন বম্বে ডীল? কিসের কথা বলছেন আপনি?
গণি আবার বসে পড়েছিলেন। আমার বিস্ময় প্রকাশের অভিব্যক্তিতে কৌতুক বোধ করে বলেন—ও হো, আপনার মনেই পড়ছে না বুঝি? আই সী! তা হবে। হয়তো এ জাতীয় কারবার প্রতি সপ্তাহেই একটা-দুটো করছেন, তাই মনে পড়ছে না। আচ্ছা একটু রেফারেন্স দিলেই মনে পড়বে। আপনার কনফিডেন্সিয়াল ফাইল নম্বর xiv/64 থেকে গত মাসের তেশরা 713/Con/xivL64 নম্বরে যে চিঠিখানা ইন্সিওার্ড ডাকে ইস্যু করা হয়েছে, সেইটির কথা বলছি আমি। যে চিঠির জন্যে আপনি আপনার বাপের আমলের কর্মচারী শম্ভ দত্তকে বরখাস্ত করেছেন। একটু একটু মনে পড়ছে এবার?
আপাদমস্তক জ্বালা করে ওঠে। মুহূর্তে স্থির করি কী করব। অস্বীকারই করতে হবে। এরা হয়তো কিছুই জানে না, শুধু কোনো সূত্রে হয়তো নম্বরটা জানতে পেরেছে। গম্ভীর হয়ে বলি–মিস্টার গণি, আপনার সঙ্গে পাগলামো করার সময় আমার নেই। আপনারা যেতে পারেন।
ভদ্রলোক ধীরে ধীরে ফোলিও ব্যাগ খুলে একখণ্ড কাগজ আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলেন— হস্তলিপি-বিশারদ যখন কোর্টে বলবেন এ-লেখা মিস্টার অলক মুখার্জির, তখন তাঁকেও কি পাগল বলবেন আপনি?
স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। আমার লং-হ্যান্ড-এ লেখা চিঠিখানির ফটোস্টাট কপি! সর্বনাশ!
–ভুল এভাবেই হয় মুখার্জি-সাহেব! টাইপ হয়ে যাবার পর টাইপড় ডুপ্লিকেটখানা ফাইলে রেখে অরিজিনালখানা ছিঁড়ে ফেলা উচিত ছিল আপনার। দেখুন দেখি কাণ্ড! কোনো কর্মচারীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও জেলের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আর উপায় রাখেননি!
মাথার মধ্যে সমস্ত গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
–সরকার আপনাকে কন্ট্রোল্ড কমোডিটিজের পারমিট দিচ্ছে আপনার ফ্যাক্টরীর জন্যে। বম্বের কালোবাজারি মহাজনের কাছে তা বেচে দেবার জন্য নয় নিশ্চয়!
কী বলব ভেবে পাই না।
গণি ঘনিয়ে আসেন—দেখুন স্যার, ব্ল্যাকমেলিং করতে আমরা আসিনি। আপনার ফ্যাক্টরীর কোন লোক এ সব কথা আপনাকে বলতে এলে লজ্জায় আপনার মাথা কাটা যেত। তাই তাদের হয়ে আমরাই কথাবার্তা বলতে এসেছি। ওদের ন্যায্য দাবিদাওয়াগুলো মেনে নিলে এ সম্বন্ধে আর কোনো উচ্চবাচ্য হবে না।
আর ইতস্তত করে লাভ নেই। বলি-বেশ, কিন্তু এখানে তো সে সব কথা হতে পারে না। আপনারা কাল আমার সঙ্গে অফিসে দেখা করুন। সেখানেই যা হয় স্থির করা যাবে।
—এটা শুভ প্রস্তাব। আশা করি কেমন করে এ চিঠি বেরিয়ে গেছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন আপনি।
একটু রুক্ষস্বরে বলি, এটা আপনার পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না মিস্টার গণি?
–আচ্ছা, তবে ও প্রসঙ্গ থাক।
ওরা উঠে পড়ে। নমস্কার করে বিদায় নেয়। যাবার আগে বলে—কাল কটার সময় ফ্রি থাকবেন আপনি? এ সব কথা তো আবার সর্বসমক্ষে–
বাধা দিয়ে বলি–কাল সন্ধ্যা সাতটায়। অফিসেই।
–আচ্ছা, নমস্কার।
ওরা চলে যেতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত একটা কথা মনে হল আমার। ভুল করেছি আমি। শম্ভুবাবু নয়। অন্য কেউ। যার মাধ্যমে এ চিঠি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে সে এখনও আছে আমার কারখানায়। না হলে আবদুল গণি কেন ব্যস্ত হয়ে উঠবে ও বিষয়ে? কেমন করে এ খবর বেরিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে আমি অনুসন্ধান চালালে ওর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার কী আছে,—যদি অপরাধী হন শম্ভুচরণবাবুই?
শম্ভুচরণ দত্ত নয়,–সর্বনাশী মিস্ পর্ণা রয়!
সমস্ত শরীরে আগুন ধরে গেল। হাতঘড়িতে দেখলাম বিকেল পাঁচটা। আজ রাত্রেই এর ফয়শালা করতে হবে। তৎক্ষণাৎ যোগীন্দর সিংকে ডেকে পাঠালাম।নির্দেশ দিলাম কলকাতা চলে যেতে। পর্ণাকে নিয়ে আসতে বললাম। অফিসে একটা ট্রাঙ্ককল করে বলে দিলাম মিস্রয়ের বাড়িতে খবর পাঠাতে। সে যেন তৈরি হয়ে থাকে। অত্যন্ত জরুরি দরকার। গাড়ি যাচ্ছে, সে যেন তাতে চলে আসে।
হিসাব করে দেখলাম রাত দশটা নাগাদ ফিরে আসবে গাড়ি। কিন্তু আসবে তো পর্ণা? সে কি আন্দাজ করেনি যে, আমি সব খবর পেয়ে গেছি? এ ভাবে তাকে ডেকে পাঠানোর উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই সে অনুমান করতে পারবে। সেই যদি অপরাধী হয় তাহলে সে নিশ্চয় জানে যে, আজ এখানে আমার কাছে আবদুল গণি আসবে প্রস্তাব নিয়ে। তারপরেই যদি আমি গাড়ি পাঠাঁই, তখন সে নিশ্চিত বুঝতে পারবে আমার উদ্দেশ্য কী। কোনো একটা অছিলা করে সে সরে দাঁড়াবে। হয় তাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না, অথবা তার শরীর খারাপ হবে কিংবা–আচ্ছা পর্ণার হোম-অ্যাড্রেস যা কোম্পানির খাতায় দেওয়া আছে সেখানে সে থাকে তো? এজাতীয় মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব।