তাহলে কে?
অনেক চিন্তা করে শেষ সিদ্ধান্তে এলাম অবশেষে। আমি ছাড়া এ সব গোপন খবর আর আর একটি মাত্র প্রাণী জানতেন। তিনি শম্ভুচরণবাবু। বাবার আমলের লোক। তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করেছিলাম। তাকে সন্দেহ করাও অত্যন্ত কঠিন। তবু তাই করতে হল। জানতে পারলাম, আমাদের এমন কয়েকটি গোপন খবর বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে যা আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না। পর্ণাও নয়! শম্ভুবাবু নিজেই সে সব চিঠি টাইপ করেছেন—স্টেনোর মাধ্যমে ছাপা হয়নি সেগুলো। চিঠিগুলি যে কনফিডেনশিয়াল ফাইলে থাকে তার চাবি অবশ্য মাঝে মাঝে পর্ণাকে দিতে হয়েছে কিন্তু সে ফাইল পর্ণা পড়ে দেখেনি নিশ্চয়।
অগত্যা চরম অপ্রিয় কাজটা করতে হল শেষ পর্যন্ত। বরখাস্ত করলাম শম্ভুবাবুকে। ভদ্রলোক বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন অর্ডারখানা হাতে করে। আমাকে তিনি খোকা বলে ডাকতেন বাবার আমলে। এখনও অবশ্য স্যার বলেন না—মুখার্জি-সাহেব বলেন।
বিহ্বলের মতো বললেন-এ কথা তুমি বিশ্বাস কর?
গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম—দেখুন, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। এটা জ্যামিতিক স্বতঃসিদ্ধান্তের মত, প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বোম্বাইয়ের ডীলটা আপনাতে-আমাতে হয়েছে। লং-হ্যান্ড-এ সমস্ত করেসপন্ডেন্স আমি লিখেছি, টাইপ করেছেন আপনি। তৃতীয় কোনো লোকের এ খবর জানার কথা নয়। সুতরাং এ খবর লিক হলে দায়ী হবেন হয় আপনি, নয় আমি। যেহেতু আমি মালিক এবং ক্ষতিটা আমার, তাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেকে না। কিন্তু আপনি? বায়রনের ভাষায় দেয়ার ইজ নো ট্রেটর লাইক হিম হুজ ডোমেস্টিক ট্রিসন প্ল্যান্টস্ দ্য পনিয়ার্ড উইদিন দ্য ব্রেস্ট দ্যাট ট্রাস্টেড টু হিজ টুথ। বুঝলেন?
শম্ভুবাবু জবাব দিতে পারেননি। জবাব ছিল না যে। তখন নিজে থেকেই বললাম—আপনি কোম্পানির যে ক্ষতি করেছেন তাতে আপনার প্রতি কোনো করুণা দেখানোর কথা নয়। তবু আপনার পাস্ট সার্ভিসের কথা মনে করে আপনাকে এক মাসের বেতন দিয়ে দিচ্ছি। কাল থেকে আপনি আর আসবেন না অফিসে। য়ু আর ডিসমিসড়।
ভেবেছিলাম নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে অফিসটাকে। শম্ভুবাবুর মত কর্মদক্ষ বিশ্বাসী লোক জোগাড় করা কঠিন–তবু ডান হাতেও যখন গ্যাংগ্রিন হয়, মানুষ তাও তো কেটে ফেলে।
ছোটাছুটি বেড়ে গেল। মাথার ওপর খঙ্গ ঝুলছে। শত্রুপক্ষের হাতে ট্রাম্পকার্ডখানা চলে গেছে। নিশ্চয়ই এখনও তা সরকারি মহলে পৌঁছায়নি। না হলে এনফোর্সমেন্ট পুলিস এতক্ষণে হানা দিত আমার অফিসে। নিশ্চয়ই ও পক্ষ একবার ব্ল্যাকমেইলিং করবার চেষ্টা করে দেখবে খবরটা পেশ করার আগে। তাই তার আগেই ছুটে এসেছি বর্ধমানে। বড়কর্তাদের কাছে আগেভাগে সাফাই গেয়ে রাখলে যদি কিছু হয়। শুনলাম, সরকারি বড়কর্তা বর্ধমানে এসেছেন ইন্সপেকশনে, উঠেছেন সার্কিট হাউসে। তাই আমিও ছুটে এলুম এতদূর।
কিন্তু সে চেষ্টাও সুবিধের হল না। বড়কর্তার সময়ই হল না।
বর্ধমানের উত্তরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারে একটা বিস্তৃত জমি নাইন্টিনাইন ইয়ার্স লিজ নিয়েছি আজ বছরচারেক। ইচ্ছা ছিল এখানে নতুন একটি কারখানা গড়ে তুলব। ফরেন এক্সচেঞ্জ জোগাড় করতে পারিনি—নানান তালে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে সে পরিকল্পনা। শুধু জমিতে প্রবেশ করবার মুখে এই ছোট্ট বাংলো বাড়িটি বানিয়েছি। বর্ধমানে এলে আমি এখানেই উঠি। এবারও তাই উঠেছি।
কাল বিকেলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সারাদিন খাটাখাটনিতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি। গাড়িতে ক্লান্তিনাশক ঔষধাদি আমার বরাবরই থাকে। ড্রাইভার যোর্গীন্দর সিং সেগুলো নামিয়ে দিয়ে গেল। জুত করে বসেছি, এমন সময় এখানকার দারোয়ান এসে খবর দিল, কয়েকজন লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। প্রথমটা অবাক হলুম। এখানে কে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে? যাই হোক তাদের ডেকে পাঠালুম।
তিনজন লোক এলেন দেখা করতে। ভদ্রলোক বলা ঠিক হবে না। অথচ ঠিক ছোটলোকও নয়। ময়লা জামা-কাপড় পরা, অথচ পায়ে জুতো অথবা চটি। কে এরা? বসতে বলব কি না স্থির করবার আগেই দেখি ওরা দিব্যি জাঁকিয়ে বসল।
-কী চাই? জানতে চাইলাম আমি।
মুখপাত্র হিসাবে যে ছোকরা কথা বলল তার বয়স অল্প। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। পরনে পায়জামা, গায়ে চুড়িদার পাঞ্জাবি, চুলগুলো অবিন্যস্ত, মুখে বসন্তের দাগ। বললে—আপনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা ছিল।
বলি, এর চেয়ে নির্জন স্থান আমার জানা নেই, কিন্তু কে আপনারা?
ছোকরা পরিচয় দিল। নিজের নয়, পার্শ্ববর্তী লোকটির। তাকিয়ে দেখলাম তার দিকে। বছর পঞ্চাশ বয়স, চিবুকে ছোট্ট নূর, চোখে গগলস এই ঘরের ভেতরেও। শুনলাম তার নাম আবদুল গণি। তিনি নাকি বানপুর অঞ্চলের নামকরা শ্রমিক নেতা।
ভদ্রলোক হাত তুলে আমাকে নমস্কার করে বলেন–আপনার সঙ্গে কখনও পরিচয় হয়নি, কিন্তু আপনার নাম শুনেছি। আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতা যেতুম; কিন্তু আপনি এখানে এসেছেন শুনে এখানেই এলুম।
বলি, সে প্রসঙ্গ তো হল—কিন্তু কেন এসেছেন সেটা তাড়াতাড়ি বলে ফেললেই ভাল হয় না?
ছোকরা বললে, আপনার যেন একটু তাড়াতাড়ি আছে মনে হচ্ছে স্যার?
বলি, তা আছে। আপনাদের যা বক্তব্য তাড়াতাড়ি সেরে নিলেই আমি খুশি হব।
মিস্টার গণি বলেন, খুব সংক্ষেপেই সেরে ফেলি তাহলে। প্রথম কথা, আপনার কারখানার শ্রমিকদের কোনও য়ুনিয়ান নেই; কিন্তু তারা আমাদের শ্রমিক য়ুনিয়ানের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড হতে চায়–