গৌতম একটু সচকিত হয়ে বলে-সুনন্দা, আজ তোমার মন নিজের এক্তিয়ারে নেই। আমি বুঝতে পারছি, কোনো কারণে তুমি আঘাত পেয়েছ মিস্টার মুখার্জির কাছে। কিন্তু আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যার জন্যে পরে অনুতাপ করতে হয়।
হঠাৎ যেন রক্তে দোলা লাগল আমার! মনে হল, কিছুই খোয়া যায়নি। পর্ণার কবল থেকে একদিন যেমন মোহজাল বিস্তার করে ছিনিয়ে এনেছিলাম গৌতমকে, আজও তেমনি ওকে এক মুহূর্তে ছিনিয়ে আনতে পারি এই অচেনা অজানা মিসেস্ ব্যানার্জির নাগপাশ থেকে। আমার উষ্ণ যৌবন, দীপ্ত নারীত্বকে অস্বীকার করতে পারবেনা গৌতম! একটু ঝুঁকে পড়ে বলি—অনুতাপ কিসের গৌতম? তুমি ঠিকই বলেছ–একটা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েই ছুটে এসেছি আমি। কিন্তু তুমি কি একটা মুহূর্তের জন্যও সে ক্ষতচিহ্নে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে পার না? এমন কিছু আমাকে দিতে পার না যা নিয়ে
কথাটা শেষ করতে পারি না। গৌতম উঠে দাঁড়ায়—বলে, প্লীস সু৷ আমিও রক্তমাংসে গড়া মানুষ। এভাবে আমাকে প্রলুব্ধ কর না।
আর স্থির থাকতে পারি না আমি। আসন ছেড়ে আমিও উঠে দাঁড়াই; বলি–তাহলে আজ আমাকে এমন কিছু একটা দাও—
এবারও শেষ হয় না কথাটা। আমাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে গৌতম আমার পেছন দিকে তাকায়। চকিতে ঘুরে দাঁড়াই। দেখি, পিঠে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে হাফ-প্যান্ট পরা একটি বছরছয়েকের ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। জুলজুল চোখে চেয়ে দেখছে আমাকে। হঠাৎ কী হল আমার। মুহূর্তে ছোঁ মেরে তুলে নিলাম তাকে। বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম সজোরে। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম তার গাল দুটো।
গৌতম স্মিতহাস্যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল আমার কাণ্ড।
০৭. ল্যভ ইজ লাইক দ্য মুন
ল্যভ ইজ লাইক দ্য মুন; হোয়েন ইট ভাজ নট ইনক্রিজ, ইট ডিক্রিজে। কোটেশানটা কার, ঠিক এই মুহূর্তে মনে আসছে না। কিন্তু কথাটা একেবারে খাঁটি। অর্থাৎ প্রেম ঠিক চাদের মতো— যখন বৃদ্ধি পাওয়ার আর উপায় থাকে না, তখন তা হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে।
আমার ক্ষেত্রে কথাটা অদ্ভুতভাবে ফলেছে।
অলক আর সুনন্দা। আমরা এক আদর্শ দম্পতি। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিলুম এই অলকনন্দা। তুষারদ্রব সুরগঙ্গা। এ অলকনন্দার ধারা ছিল নির্মল, পবিত্র, স্বর্গীয়। পার্থিব মলিনতার স্পর্শ লাগেনি এর গায়ে। আমাদের দুজনেরই মন ছিল কানায় কানায় ভরা—দুজনকে নিয়ে।
মহাপ্রস্থানের যাত্রাপথে শুনেছি অলকনন্দার অববাহিকা ধরে চলতে হয়। যাত্রীদল অন্যমনে পথ চলে—লক্ষ্য তার মহাতীর্থের দিকে—সারা পথে অলকনন্দার উপলমুখর কুলুকুলু ধ্বনি শুনতে শুনতে চলে; সারা পথ দেখতে দেখতে যায় স্বচ্ছতোয়া রজতশুভ্র জলধারার প্রবাহ। দূর থেকে অলকনন্দা ওদের উৎসাহ যোগায়, প্রেরণা দেয়। কিন্তু ক্ষণিক বিচ্যুতিতে যদি ঐ খাড়া খাদের দিকে যাত্রীর পদস্খলন হয়, তখন ঐ অলকনন্দা ভয়ঙ্করী মৃত্যুর মত করাল গ্রাসে টেনে নেয় তাকে।
ফেনিল আবর্তে অবলুপ্ত হয়ে যায় তীর্থযাত্রীর শেষচিহ্ন।
আমাদেরও হয়েছে তাই। খেয়াল-খুশিতে পথ চলতে চলতে হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছি অলকনন্দার খাদের সম্মুখে। আমরা দুজনেই! জানি না, পদস্খলন কার আগে হবে।
সুনন্দার কথা ঠিক জানি না। নিজের কথাটা জানি। এতদিন আকণ্ঠ ডুবে ছিলুম নন্দার প্রেমে। শশীকলার মতোই দিন দিন তার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে চলছিল; কিন্তু তারপর যেমন হয়। মন যখন পূর্ণিমায় কানায় কানায় ভরে গেল তখনই দেখলাম–মনের অনেকটাই ফাঁকা। আর তারপর–হোয়েন ইট ডাজ নট ইনক্রিজ, ইট ডিক্রিজেস!
এটা বোধহয় পুরুষের ধর্ম। যা পাওয়া গেছে তার ওপর আর মোহ থাকে না–যা পাওয়া গেল না, মনটা তাকে নিয়েই মেতে ওঠে। রবিঠাকুরের কী একটা লাইন আছে না? যাহা পাই না তাহা চাই না–না ঐ-জাতীয় কিছু?
আজ আর অস্বীকার করে লাভ নেই, পর্ণা আমার মনে আবর্ত তুলেছিল। হয়তো তার জন্য কিছুটা দায়ী আমার স্বাভাবিক পুরুষের ধর্ম, কিছু হয়তো তার বিচিত্র মোহবিস্তারের কায়দা হয়তো বা কিছুটা সুনন্দার সাম্প্রতিক ব্যবহার।
ভেবেছিলুম, মনের এ পরিবর্তনটুকু গোপন করে যাব। বস্তুত আমার চেতন মনের কাছে প্রথমাবস্থায় অবচেতন মনও এটা গোপন রাখতে পেরেছিল। কিন্তু প্রথমাবস্থায় তো চিরকালই কোনো কিছু থাকে না।
আর এ এমন একটি জিনিস যা চিরকাল লুকিয়ে রাখা যায় না। হার্বাট ঠিকই বলেছেন—এ ল্যভ অ্যান্ড এ কা ক্যানট বি হিড। প্রেম আর সর্দি-কাশি লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। সুনন্দা কিছুটা আন্দাজ করেছে এতদিনে।
যেদিন বুঝলুম–সুনন্দা আন্দাজ করেছে, সেদিন থেকে আরও যেন বেপরোয়া হয়ে পড়েছি। সেই বেলেঘাটার মোড়ে মধ্যরাত্রে শোনা ডনের উদ্ধৃতিটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না!
কিন্তু আপাতত আমার মনের কথা থাক। তার চেয়ে বড় বিপদ ঘনিয়ে উঠেছে বাস্তবে। যার জন্য ছুটে আসতে হয়েছে এই বর্ধমানে।
কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করেছি, আমাদের কারখানা থেকে গোপনতম খবর কেমন করে জানি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতদিন পর্ণা ও-তরফের গোপন খবর সরবরাহ করত আমাকে। সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। পর্ণা বলে, তার সেই পঞ্চাশ টাকা বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবের পর থেকেই। যেমন করেই হোক, ও-পক্ষ সে খবরটা পেয়ে গিয়েছিল এবং তারপর থেকেই শ্রমিক নেতা ব্যানার্জি আর পাত্তা দেয় না পর্ণাকে। এখন আবার গোপন খবরের উজান বইতে শুরু করেছে। কে আছে এর মূলে? পর্ণাকে সন্দেহ করতে মন সরে না। সে এখন পুরোপুরি আমার এক্তিয়ারে। সে আমাকে ভালবাসে। গৌতমের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে আরও ঘনিয়ে এসেছে আমার কক্ষপুটে। কুমারী মেয়ে যখন কাউকে ভালবাসে তখন তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। যতদিন না আমার কাছ থেকে প্রতিহত হচ্ছে ততদিন সে এ কাজ করবে না।