গৌতম হাসল। জবাব দিল না।
–তোমার ছেলেটি কোথায়?
–ছেলের খবর পেলে কার কাছে?
বলি–গৌতম, আমি তো প্রশ্ন করিনি, তুমি আমার স্বামীর খবর কার কাছে পেয়েছিলে।
গৌতম সে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে বলে–বল্ট স্কুলে গেছে।
–স্কুল? সে কোথায়?
–ঐ তো! প্রাইমারি স্কুল। এখনই আসবে সে। চা খাবে?
—খেলে তোমাকেই বানাতে হবে তো?
–কেন? তুমিও বানাতে পার।
—পারি? তবে চল।
এলাম ভেতরের ঘরে। ছোট বাড়ি, দুখানি মাত্র ছোট্ট ঘর। ভেতরে একটি বারান্দা। তারই একান্তে রান্নার আয়োজন। কাঠের উনুন। দেওয়ালে লটকানো একটি প্যাকিং বাক্স। তাতে রান্না করার নানান উপচার। মশলার কৌটা, আচার, নুনের কেঠো। একটা ঝুড়িতে কিছু আনাজ আলু, বেগুন, পেঁয়াজ, কচু আর আদা। মাটিতে কলসিতে মোটা চাল। ছোট্ট একটি বঁটি, চাকতি-বেলুন, শিল-নোড়া। গৌতম বললে—সরো, উনুনটা জ্বেলে দিই।
–থাক মশাই, আমিই পারব।
—না পারবে না—ফুঁ দিতে দিতে শুধু শুধু চোখে জল আসবে।
হেসে বলি—শরবাবুর বইতে পড়নি রান্নাঘরের ধোঁয়া বাঙালি মেয়েদের চোখের জল লুকোবার একটা ভাল অছিলা?
–তোমারও কি কোটেশান খেলার বাতিক আছে নাকি?
চমকে উঠে বলি—তার মানে?
গৌতম অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলি—শুনেছি মিস্টার মুখার্জি নাকি অ্যাপ্ট কোটেশানের ভারি ভক্ত।
—সেটাও শুনেছ? এত কথা শোন কার কাছে?
গৌতম আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দেয়। বলে—আমি তো প্রশ্ন করিনি সু—আমার ছেলের কথা তুমি কার কাছে শুনেছ।
হেসে বলি-টুইটস! নাও সরো, উনুনটা ধরাই।
কিন্তু কী লজ্জা! কিছুতেই জ্বালতে পারি না কাঠের উনুনটাকে। গৌতম একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। এতক্ষণে এগিয়ে এসে বলে—নাও, খুব হয়েছে। বরং এইটা জ্বেলে নাও।
জনতা স্টোভ একটা টেনে আনে কোথা থেকে।
দু-কাপ চা তৈরি করে নিয়ে এসে বসলাম ওর ঘরে! সেইটা মনে হয় ওদের শয়নকক্ষ। এটাই বড় ঘর। দুখানা চৌকি পাতা। ধবধবে সাদা চাদর। বালিশ-ঢাকায় কাজ করা। ছোট একটি টিপয় টেনে আনল গৌতম। চায়ের কাপ দুটি রাখল তার ওপর। আমি বলি–টিপয়ও আছে?
গৌতম হেসে টেবিল-ঢাকাটা তুলে ফেলে। কেরোসিন কাঠের বাক্স একটা। সুদৃশ্য টেবিল-ঢাকায় তার ভোলাই পাল্টে গিয়েছে। গৌতম হেসে বলে–অত কৌতূহল দেখিও না সু! নিম্নমধ্যবিত্তের সংসার খুঁটিয়ে দেখতে চেয়ো না। কোনোক্রমে ওপরের ঐ কোচার পত্তনটি বজায় রেখেছি আমরা। ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন!
আমি হেসে বলি–সে সর্বত্রই! পোশাকের তলায় সবাই উলঙ্গ!
আবার একটু চুপচাপ।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ওর গৃহস্থালির আয়োজন। উপকরণ সামান্যই—কিন্তু কী সুন্দর গুছিয়ে রেখেছে। মনে হল, সুন্দর গৃহস্থালির একটি অনিবার্য উপকরণ হচ্ছে অভাব! প্রাচুর্যের মধ্যে কিছুতেই এ মাধুরী ফুটিয়ে তোলা যাবে না। ঐ যে ছেড়া শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়ার ওপর আসন তৈরি হয়েছে, ঐ যে মাটির ঘটে আলপনা দিয়ে স্থলপদ্ম রাখা আছে, ঐ যে ছেড়া ধুতি বাসন্তী রঙে ছুপিয়ে জানলার পর্দা করা হয়েছে—ও জিনিস কিছুতেই পাওয়া যাবে না সুনন্দা মুখার্জির ড্রইংরুমে। কারণ ওর মূল সুরটাই হচ্ছে অভাবের মাঝখানে ফুটে ওঠা রুচিবোধ। তাজা পদ্মফুলের অনিবার্য অনুষঙ্গ যেমন পাঁক, এই গৃহস্থালির মূল সুরটিও যেন তেমনি-অনটন। এমনটি করে ঘর সাজাতে পারব না আমি কোনোদিন-এ কি আমার কম দুঃখ! জোর করে মাটির ঘট নিয়ে গেলে তাতে উপহাসের হাওয়াটাই লাগবে, অনাবিল হাসির সুরটা ফুটবে না।
–কী দেখছ অত চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে?
–দেখছি মিসেস ব্যানার্জির কোনো ফটো আছে কিনা দেওয়ালে।
–হতাশ হতে হবে তাহলে তোমাকে। তার কোনো ফটো এ বাড়িতে নেই।
আমি বলি, বুঝেছি। নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।
গৌতম হেসে বলে–নো কোটেশন প্লীজ! আমি ওটা একদম সইতে পারি না।
–তুমি দেখছি অলকের একেবারে ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা।
–তা বলতে পার?
আবার কিছুটা চুপচাপ।
নীরবতা ভেঙে আবার আমাকেই বলতে হয়—তোমার চিঠি পেয়েছি কিনা প্রশ্ন করলে না তো?
–প্রশ্ন না করলেও বুঝতে পারছি, তা তুমি পেয়েছ।
–তবু ঢুকতে দিলে বাড়িতে? ভয় নেই?
—ভয় কিসের?
–যদি আবার বিশ্বাসঘাতকতা করি? গৌতম হেসে বলেসে জন্যে তো তুমি আসনি।
–তবে কেন এসেছি?
—তা তুমিও জান, আমিও জানি–কী দরকার সেই কথাটা উচ্চারণ করে। সেটা অকথিতই থাক। তাতে তার মাধুর্য বাড়বে।
কেমন যেন লজ্জা করে ওঠে। মুখটা আর তুলতে পারি না। নিচু মুখেই অস্ফুটে বলি—একটা কথা সত্যি করে বলবে?
–বল।
–আমাদের গেছে যা দিন, তা কি একেবারেই গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?
গৌতম স্মিতমুখে চুপ করে বসে থাকে।
বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কই, জবাব দিলে না?
–ভাবছি, এত কোটেশন দিচ্ছ কেন আজ। ধার করা কথা ছাড়া নিজের কথা কিছু বলতে পার না?
–মানে?
–মানে, তোমার ও কথার জবাবে একটি মাত্র কথাই তো বলা চলে—রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে!—কিন্তু তুমি-আমি তো তোতাপাখি নই সু!
অপ্রস্তুত হতে হল। বলি—বেশ, স্থূলভাবেই প্রশ্ন করছি—মিসেস ব্যানার্জি কি তোমার মনের সবটুকুই ভরিয়ে রেখেছেন—কিছুই কি নেই বাকি?
গৌতম একটুক্ষণ চুপ করে রইল-তারপর বলে–এ প্রশ্নটার জবাব দেওয়া কি আমার পক্ষে শোভন? থাক না ও কথা!
আমি হেসে বলি–আমার প্রশ্নের জবাব তুমি দিলে না গৌতম; কিন্তু তোমার চোখ-মুখ বলছে সে কথা! তোতাপাখির কথা নয়, আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তোমার চোখের তারায় ফুটে উঠেছে সেই তারা, যা লুকিয়ে রেখেছিলে তোমাকে, তোমার দিনের আলোর গভীরে।