কিন্তু কেমন এমন হল? অলককে নিয়ে আমি সুখী না হবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমার মনের অনেকখানি ছিল ফাঁকা। প্রাপ্তির প্রাচুর্যে সে ফাঁকটি ভরেনি। প্রেমিকের জন্যে কৃচ্ছ্বসাধনের সুযোগ আমি পাইনি, দাম্পত্য-কলহের স্বাদ আমাকে পেতে দেয়নি অলক,স্বামীর ক্ষুধার অন্ন জোগাতে নিজের মুখের গ্রাস লুকিয়ে ধরে দেবার যে বিমল আনন্দ তা থেকে সে আমাকে চিরবঞ্চিত করেছিল। তা ছাড়া আমার ভেতরে চিরকালই লুকিয়ে ছিল একজন দুঃসাহসিকা। সে বেপরোয়া, সে দুর্মদ, সে অভিসারিকা। তার খোঁজই জানে না অলক। তাই অন্য কোনো আকর্ষণে দাম্পত্য জীবনচক্রের আবর্তন থেকে কেন্দ্রাতিগ বেগে ছুটে যাবার একটা তির্যক বাসনা আমার মনে জাগলেও জাগতে পারে। গৌতমের প্রেমে সম্মোহিত হবার উপাদান ছিল আমার রক্তের স্বাক্ষরে। কিন্তু সে কেন এমন লুটিয়ে পড়ল ঐ সামান্যার মোহে? কী আছে পর্ণার, যা আমার নেই? কোন স্বাদে অলক বঞ্চিত আমার কাছে?
অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলাম। স্থির করলাম, এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। অলক যদি একনিষ্ঠ প্রেমের মর্যাদা না দেয় তাহলে আমিই বা সে দায় একা বয়ে বেড়াব কোন দুঃখে!
পরদিন সকালে উঠেই ছুটলাম গৌতমের ছাপাখানায়।
এবার আর আটপৌরে শাড়ি নয়, স্বাভাবিক সাজে ভড়ংও নেই, আড়ম্বরও নেই। যে বেশে সেই কলেজ জীবনে দেখা হত আমাদের, সেই বেশে। ট্যাক্সি করেই যেতে হল। বাড়ির গাড়ি ও-পাড়ায় নিয়ে যাবার কী দরকার? গৌতম ছিল না তার ছাপাখানায়। ছিলেন সেই ভদ্রলোক, যিনি সেদিন আমাদের দু কাপ চা এনে দিয়েছিলেন।
কথাবার্তা শুনে মনে হল তিনি এখনও আমার পরিচয়টা জানেন না। গৌতম কখন আসবে তা তিনি বলতে পারলেন না।
বললাম—কোথায় গেলে তার দেখা পেতে পারি?
–বাসাতেই থাকেন এ সময়। অবশ্য এখন আছেন কিনা জানি না।
–বাসা কোথায়?
—যাবেন আপনি? বেশি দূর নয়। এই গলিটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই একটা বাঁশের পুল পাবেন। সেটা পার হয়েই ডানহাতি করোগেট টিনের চারচালা বাড়ি। যাকে শুধাবেন, সেই পথ বাতলে দেবে।
–আর কে কে আছেন তার বাসায়?
–তিনি, তার স্ত্রী আর একটি ছেলে। স্ত্রী অবশ্য আজ নেই। কাল কোথায় যেন গিয়েছেন।
—কোথায় গিয়েছেন?
–তা তো জানি না। কাল রাত্রে এখানে এসে বললেন যে, দুচার দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছেন। গৌতমবাবু তখন এখানেই ছিলেন কিনা।
-ও!
–চলুন, আপনাকে বরং দেখিয়ে দিই।
কৌতূহল প্রবল। তার ওপরে গৌতমের স্ত্রী আজ বাড়ি নেই। এ সুযোগ ছাড়া হবে না। দেখে আসা যাক ওর সংসারের স্বরূপ। সংসারের প্রেমে সে নাকি মগুল হয়ে আছে।
ভদ্রলোক দরজায় শিকল তুলে তালা লাগালেন। দুজনে পথে নামি। নোংরা গলি। যেখানে-সেখানে নির্বিচারে ময়লা ফেলা আছে। পথ জুড়ে শুয়ে আছে রোমন্থনরত নিশ্চিন্ত গো-শাবক। নির্বিচারে উলঙ্গ দুটি শিশু পথের ধারে প্রাতঃকৃত্য করতে বসেছে। একটা ঠেলাওয়ালা পথের আধখানা আটক করে পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছে। মুখের ওপর গামছা ফেলা। দেখতে দেখতে পথ চলেছি। সামনের বাড়ির বউটি আঁচল দিয়ে সারা গা ঢেকে একটা এনামেলের পাত্রে আঁজলা ছাই নিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল পথে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। এত সুন্দরী মেয়ে বোধহয় এ সব পাড়ায় আসে না। বউটি ছাই ফেলতে ভুলে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। এ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমি অভ্যস্ত। এতদিন ভাবতুম এ আমার রক্ষাকবচ-সহজাত কবচকুণ্ডল। হার রে রূপ! সে দেমাক আমার গিয়েছে।
–সাবধানে পার হবেন।
বাঁশের পুলের কাছে এসে গেছি। আমি চাই না যে, ও ভদ্রলোক আমার সঙ্গে আসেন। তাই তাকে বিদায় করবার জন্য বলি–এবার আমি যেতে পারব। ঐ বাড়িটা তো?
ভদ্রলোক মনে হয় ক্ষুণ্ণ হলেন। আমার পাশে চলতে বেশ একটা আনন্দ বোধ করছিলেন বোধ করি। কিন্তু আমার কথার জবাবে তাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল–আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা, আমি তাহলে চলি।
-হ্যাঁ, আসুন।
ছোট্ট দুকামরা বাড়ি। টিনের চালা, মুলিবাঁশের ছেচা-বেড়ার দেওয়াল। মেঝেটা অবশ্য পাকা। সামনে একটু বাগান। তাতে নানান ফুলের গাছ। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মধুমালতীর গেট। সন্ধ্যামণি, বেলি, জুই, দণ্ডকলস আর রজনীগন্ধার চারা। আমার দিকে পেছন ফিরে গৌতম বেড়া বাঁধছিল। খালি গা। পরনে একটা পায়জামা। গলায় মোটা পৈতে। চুলগুলো অবিন্যস্ত। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে। তার একহাতে একখানা কাটারি, অন্য হাতে আধলা বাঁশ। গেটটা খুলতেই মুখ তুলে তাকায়। অবাক হয়ে যায় গৌতম। উঠে দাঁড়ায়, বলে–তুমি?
হেসে বলি–হ্যাঁ আমিই-কিন্তু ভেতরে আসব তো?
–কেন আসবে না?
–আমি যে নিরস্ত্র, আর তুমি সশস্ত্র! বিশ্বাসঘাতককে খতম করতে কতক্ষণ?
–ছিঃ! কী যা তা বলছ? এস, ঘরে এস—
দা-খানা ফেলে হাতের ধুলো ঝেড়ে দাওয়ায় উঠে দাঁড়ায়। বেতের মোড়া একখানা টেনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে—বস।
একটু অভিনয় করতে হল। বলি, আসতে বলেছ এসেছি; কিন্তু বসতে তো তুমি বলবে না। গৃহস্বামিনীকে ডাক—তিনি অনুমতি করলেই বসতে পারি।
গৌতম হেসে বলে–তিনি উপস্থিত থাকলে তাই হত। কিন্তু তিনি যে বাড়িতে নেই।
—আয়াম সরি। বাজারে গেছেন নাকি?
না, তিনি কলকাতাতেই নেই আজ।
—ও হো। তবে তো আমার আসাটাই আজ ব্যর্থ হল।
–তাই নাকি? তাহলে তুমি আমার কাছে আসনি দেখছি।
-না তোমার কাছে নয়, তোমাদের কাছে এসেছিলাম আজ। দেখতে এসেছিলাম কী মন্ত্রে তিনি বশ করেছেন তোমায়।