-কে নিয়ে গেল? কোথায়?
বৃদ্ধ যেন এর জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, বলেন–এইমাত্র আসানসোল থেকে গাড়ি এসেছিল ওঁর স্টেনোকে নিয়ে আবার গাড়ি সেখানে ফিরে গেল।
আমি সচকিত হয়ে বলি–সে কী! কেন?
–সে কথাই তো আলোচনা করতে এসেছিলুম মা; কিন্তু তুমি দেখছি এ বরখাস্ত-করা কর্মচারীকে বরদাস্ত করতে নারাজ।
গরজ বড় বালাই! ওঁকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে বলি—আপনি অহেতুক আমার ওপর রাগ করছেন। আমি যে সব কথা বলিনি তাই আমার মুখে বসিয়ে খামখা আমাকে দোষারোপ করছেন। কী হয়েছে আমাকে খুলে বলুন কাকাবাবু। আমিও দেখি আপনার জন্য কিছু করা যায় কিনা।
আবার বসে পড়েন বৃদ্ধ। বলেন–না, আমার জন্য কিছু আর করার নেই। সে অনুরোধও আমি করব না। কিন্তু তুমি এবার নিজের ঘর সামলাও, মা। আমার ঘর ভেঙেছে, তা ভাঙুক–আমার জীবনের বাকিই বা কী আছে? কিন্তু তোমাকে যে অনেকটা পথ এখনও চলতে হবে।
বুকের মধ্যে দুরদুর করে ওঠে। বলি—কেন, আপনি কি তেমন কিছু আশঙ্কা করেছেন?
—তা করছি। সে সব কথা আগে বলতে আমার সঙ্কোচ হত না। আজ তোমার মনে হতে পারে, আমি বুঝি প্রতিশোধ নিতেই কতকগুলো মিছে কথা বানিয়ে বলে যাচ্ছি–
-না না না। আমি তা মনে করব না। আপনি বলুন। সব কথা আমাকে খুলে বলুন! উনি কি পর্ণাকে নিয়ে
–হ্যাঁ তাই। সন্দেহটা আমার অনেকদিনই হয়েছিল। কানাঘুষা অনেক কিছুই শুনেছি। বিশ্বাস করিনি; বিশ্বাস করতে মন চায়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা দুজনেই ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। আশ্চর্য! যার ঘরে এমন সতীলক্ষ্মী বউ
লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমার। কিন্তু ও বৃদ্ধের কাছে আর লজ্জা করে কী হবে? বলি–কেমন করে এমন হল কাকাবাবু?
–কেমন করে হল তা বলা বড় শক্ত মা। বোধ করি পুরুষমানুষের ধর্মই এই। যা হাতের কাছে। অনায়াসে পাওয়া যায় তাতে তার তৃপ্তি নেই! তা বড়লোকের সমাজে এটা তেমন কিছু নয়, আমিও এটাকে অতটা গুরুত্ব দিতুম না; দিতে হচ্ছে অন্য কারণে। এ মেয়েটির সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে আমার ভয় হয়েছে এ শুধু তোমার ঘরেই নয়; তোমাদের কারখানাতেও আগুন জ্বালাবে! একটি গোপন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। অলককে সে কথাই বলতে গেলুম–কিন্তু সে যেন নেশার ঘোরে আছে। আমার কথায় কান তো দিলেই না, অহেতুক অপমান করে বসল আমাকে।
আমি বলি–আপনি আমাকে কী করতে বলেন?
–অসম্ভব কিছুই করতে বলি না। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণ গৃহস্থ বধূ যা করে থাকে তাই করবে। অলককে সরিয়ে নিতে হবে পর্ণার সান্নিধ্য থেকে। ও মেয়েটি সর্বনাশা, ওকে তাড়াতে হবে।
আবার বলি—কিন্তু আপনি যদি আমাদের ছেড়ে যান, তাহলে কেমন করে আমি তা পারব বলুন? আপনাকে তো যেতে দেওয়া যাবে না।
–কিন্তু রাখবে কেমন করে মা? সে সব বরং থাক। আপাতত আমি যাই। যে অলক্ষ্মী ওর উপর ভর করেছে, ঘাড় থেকে সে অলক্ষ্মী নামলে ওর শুভবুদ্ধি আপনিই জাগ্রত হবে। তখন হয়তো সে আবার আমাকে ডেকে পাঠাবে। ওকে আমি সন্তানের মতোই স্নেহ করি। তখন আমি অভিমান করে দূরে সরে থাকব না।
—পর্ণা যে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, এ খবর আপনি কেমন করে জানলেন?
-ঐ যে বললাম, এ সব কথা আমাদের জানতে হয়। এত বড় কারখানাটা যাকে চালাতে হয়, তাকে অনেক খবর সংগ্রহ করতে হয়।
—ওঁকে আপনি বলেছিলেন সে কথা? উনি বিশ্বাস করেননি?
—তার বুদ্ধি যে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মা। তাকে ঐ মেয়েটি সম্মোহিত করে ফেলেছে।
কেমন যেন মাথা কাটা গেল আমার।
বৃদ্ধ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি স্থাণুর মত বসেই রইলুম। সারারাত ঘুম হল না। আবোলতাবোল চিন্তায় সমস্ত রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছি। কেন এমন হল? অলক আর সুনন্দা দুটি সুখী প্রাণী। আদর্শ দম্পতি। ভেবেছিলাম, একটি মেয়ে জীবনে যা যা কামনা করতে পারে সবই আমার করতলগত হয়েছে। সম্মান, প্রতিপত্তি, বিলাস, বৈভব-রূপবান, স্বাস্থ্যবান স্বামীর একান্ত প্রণয়। কী নয়? নিজের পছন্দমত শাড়ি গাড়ি কিনেছি। নিজে আর্কিটেক্টের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করিয়েছি। কোন ঘরে কী রঙের টাইল বসবে, কী রঙের প্লাস্টিক ইমালশান রঙ হবে, কী ধরনের পর্দা হবে–সব আমি স্থির করে দিয়েছি। এমনকি গেটের পাশে আলোর টোপরা-পরা বাড়ির ঐ নেমপ্লেটে কী লেখা হবে তাও স্থির করে দিয়েছি আমি। মনে আছে এ প্রসঙ্গে ওর সঙ্গে যে রহস্যালাপ হয়েছিল। বাড়ি যখন শেষ হয়ে এল অলক বললে—এবার এ বাড়ির একটা নামকরণ করতে হয়।
আমি বলেছিলুম–কর। বাড়িটার কোথায় কী করতেহবে তা আমিই নির্ধারণ করেছি, অন্তত নামটা তুমি দাও।
ও বলেছিল-বাড়ির নামকরণ সম্বন্ধে ডক্টর জনসন কী বলেছেন জান?
আমি বলি—ডক্টর জনসনের উপদেশ থাক। তুমি চটপট একটা নামকরণ কর দেখি।
—সে কি হয়! তুমি বাংলার ছাত্রী। নাম দিতে হয়, তুমিই দেবে।
মনে আছে, আমি বলেছিলাম–তবে নাম দাও অলকাপুরী!
ও লাফিয়ে উঠে বলেছিল—কক্ষনও নয়! অলকের নাম থাকবেই না, ওর নাম হোক নন্দালয়। তাতে আমার ঘোর আপত্তি। শেষ পর্যন্ত মধ্যপথে রফা হল আমাদের। নামটা আমিই দিলাম অবশ্য-অলকনন্দা।
অলক আর সুনন্দা দুটি নাম একসঙ্গে গ্রথিত হয়ে গেল পাষাণের ফলকে।
হার রে নাম! সেদিন দূর থেকে কুলুকুলু ধ্বনিতে প্রবাহিত অলকনন্দার ধারাকেই দেখেছিলাম। আজ দেখলাম খাড়া প্রেসিপী! অলকনন্দার খাদ! সে খাদ অলকের সোনাতেও ছিল, সুনন্দার সুবর্ণেও ছিল। সংসারের উত্তাপে প্রেম কোথায় থিতিয়ে পড়েছে। ওপরে ভাসছে শুধু খাদ!