—অলক তাহলে তোমাকেও কিছু বলেনি দেখছি।
—না। কিন্তু হঠাৎ আপনাকে বরখাস্ত করার কারণ?
—সেটাই বলতে এসেছি। সঙ্কোচও সেইজন্য। প্রথমত এ কথা ঠিক, এ বৃদ্ধ বয়সে আমার পক্ষে বিকল্প চাকরি জোগাড় করা অসম্ভব। সংসারে তোমার কাকিমা ছাড়াও আমার একটি বিধবা মেয়ে আছে। তাদের কেমন ভাবে খাওয়াব-পরাব জানি না।
বুঝতে পারি, সেইজন্য দরবার করতে এসেছেন উনি। এ সব ক্ষেত্রে সচরাচর আমি নাক গলাই–জানি, আমার স্বামী কখনও কোনো অন্যায় করেন না। এক্ষেত্রেও না জেনেও আমি স্থির-নিশ্চয়–নিশ্চিত শম্ভুচরণবাবু এমন কোন অপরাধ করেছিলেন যার ক্ষমা নেই। নাহলে কারখানার শৈশবাবস্থা থেকে যে কর্মচারী এর সঙ্গে যুক্ত, যে ওর পিতৃবন্ধু, যার চাকরি যাওয়া মানে একটি পরিবারের নিশ্চিত অনশন-মৃত্যু–তাকে এভাবে পদচ্যুত করত না অলক। সে জাতের মানুষ নয় আমার স্বামী।
বৃদ্ধও সেই কথাই বলেন। বললেন–তোমার জানার কথা নয় মা, তোমার শ্বশুর জানতেন সে সব কথা। অলক তখন বিলাতে। লেখাপড়া করছে। তোমার শাশুড়ি ঠাকরুন মারা গেলেন। তখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চলছে—অলক আসতে পারল না। আমাকেই সব কাজ করতে হল। অলকের বাবা শুধু আমার অন্নদাতাই ছিলেন না–তিনি ছিলেন আমার বন্ধু। স্ত্রী-বিয়োগের পর তিনি বোধহয় মাসছয়েক কারখানায় বার হননি। চাবিকাঠি পর্যন্ত ধরে দিয়েছিলেন এই বুড়োর হাতে। আমি পরলোকে বিশ্বাস করি মা;–আমি জানি, ওপর থেকে তিনি দেখেছেন আমি নিমকহারামি করেছি কিনা!
কোঁচার খুঁট দিয়ে চোখটা মোছেন উনি।
বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কিন্তু আপনাকে বরখাস্ত করার কারণ তো কিছু একটা আছে?
গলাটা সাফ করে নিয়ে তিনি বলেন–তা আছে। আমাকে অলক আর বিশ্বাস করে না। আমি নাকি বিশ্বাসঘাতক।
আমাকে চুপ করে থাকতে হয়।
বৃদ্ধ আপনমনেই বলতে থাকেন—-কারখানার কিছু গোপন খবর বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। সব কথা তোমাকে বলতে পারব না আমি। কিন্তু সে সব খবর অলক আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। জানার কথা নয়। তাই ও মনে করে–
মাঝপথেই থেমে পড়েন উনি। আমি পাদপূরণ করে দিই—সেটা কি অস্বাভাবিক? আপনিই বলুন? বৃদ্ধ চোখ দুটি আমার মুখের ওপর তুলে বলেন—হা অস্বাভাবিক। এতে আর্থিক ক্ষতি অবশ্য আমার নয়, অলকের। কিন্তু এতে অলক যতটা আঘাত পেয়েছে তার অনেক বেশি পেয়েছি আমি! এ যে আমার নিজে হাতে গড়া কারখানা, মা।
আমি বললাম—কিন্তু, আপনি তো নিজেই বলছেন যে, আপনারা দুজন ছাড়া সে সব খবর আর কেউ জানতনা। দ্বিতীয়ত, আপনাদের শত্রুপক্ষ নিশ্চয়ই এ খবরগুলো উচ্চমূল্যে সংগ্রহ করতে রাজি, নয় কি?
–তা তো বটেই!
–তবে আর অলককে কী দোষ দেব? সে তো ঠিকই করেছে। আমি তো আপনার হয়ে কোনো সুপারিশ করতে পারব না।
বৃদ্ধ একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন—তুমি আমায় ভুল বুঝেছ, মা। আমি তোমার কাছে দরবার করতে আসিনি। তুমি আমার হয়ে সুপারিশ কর, এ কথা বলতেও আমি আসিনি
আমি বললুম–তবে কি বিদায় নিতে এসেছেন?
বৃদ্ধ বলেন–হ্যাঁ, তা বলতে পার। যাবার আগে তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হবে বৈ কি। কিন্তু শুধু সে জন্যও আসিনি। তোমাদের ছেড়ে চলে যাবার আগে তোমাকে বিশেষ করে কয়েকটি কথা বলে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি আমি। না হলে তোমার শ্বশুর, আমার সেই অন্নদাতা বন্ধুর কাছে আমার অপরাধ হবে।
আমি চুপ করে বসে থাকি।
বৃদ্ধ বলেন—দেশে আমার সামান্য জমি আছে। সেখানেই গিয়ে উঠব। কোম্পানির দেওয়া বাড়ি আমাকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। দেশের বাড়িতে গুটিকয়েক ছেলেকে পড়াব স্থির করেছি। মনে হয়, কোনো রকমে ভদ্রভাবে দিন কেটে যাবে আমার। শেষদিনের বড় বেশি বাকিও তো নেই।
তারপর আমার বিরক্ত মুখের দিকে চেয়ে বলেন–বুঝেছি মা, এ সব কথা তোমার ভাল লাগছে। তবে এ কথা থাক। কিন্তু যে কথা না বলে যেতে পারছি না, সেটা যে বলতেই হবে।
–বলুন?
—অলকের নতুন স্টেনোটি কি তোমার বান্ধবী?
আমি অবাক হয়ে যাই। এ কথা শম্ভুবাবু কেমন করে জানলেন! একটু বিস্ময়ের অভিনয় করে বলি—কার কথা বলছেন আপনি?
—অলকের নূতন স্টেনো–পর্ণা রায়–কি তোমার সহপাঠিনী ছিল?
বুঝতে পারি, অস্বীকার করাটা বোকামি হবে, তাই বলতে হল—হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?
–আমাকে সব কথা জানতে হয় মা। না হলে এত বড় কারখানার কোথায় কী হচ্ছে কেমন করে খবর রাখব বল? তা মেয়েটির সম্বন্ধে তুমি কত দূর কী জান, বল ত।
–কত দূর কী জানি মানে?
–ওর স্বভাব চরিত্র-সম্বন্ধে, ওর জীবনের সম্বন্ধে?
—বিশেষ কিছুই জানি না। কিন্তু এ সব প্রশ্ন কেন করছেন আপনি?
–করছি, কারণ করাটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তোমার শ্বশুর আজ উপস্থিত থাকলে তিনিই এ প্রশ্ন করতেন।
আমি একটু রুক্ষ স্বরে বলি—কিন্তু আমার শ্বশুরকে যে জবাব আমি দিতাম, তা–
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বলে ওঠেন—তা আমার স্বামীর বরখাস্ত-করা কর্মচারীকে আমি দিতে বাধ্য নই,—এই তো?
আমি চুপ করে থাকি। অপমানে ওঁর মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে। বলেন-আমারই ভুল মা, আমারই ভুল। তোমার কাকিমাও বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, চাকরিই যখন রইল না, তখন এ সব কথার মধ্যে আমাদের না থাকাই ভাল। বেশ তোমার ভালমন্দ তুমিই বুঝে নিও। আমি বরং চলি
উঠে দাঁড়ান উনি।
আমি একটু ইতস্তত করে বলি–উনি কি আজ আসবেন না?
লাঠিখানা তুলে নিতে নিতে উনি বলেন—বোধহয় না। এলে আর কেন গাড়ি পাঠিয়ে পর্ণাকে নিয়ে যাবেন?