কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। সে বিশ্বাসটুকুও তুমি আমাকে আঁকড়ে থাকতে দিলে না। তুমি দ্বিতীয়বার এলে না আমার সেই ভাঙা অফিস ঘরে। ডাকের সাহায্যে শুধু আমার কাগজের প্রুফ পাওয়াতেই তোমার আগ্রহ দেখলুম। তাই এই চিঠি।
সেদিন তুমি প্রশ্ন করেছিলে, আমার বউ পছন্দ হয়েছে কিনা। তখন জবাব দিইনি, এখন দিচ্ছি। হ্যাঁ, দাম্পত্যজীবনে আমি পুরোপুরি সুখী। তোমার সব কথা তাকে খুলে বললুম, এ চিঠিও দেখিয়েছি তাকে।
তুমিও ইচ্ছে করলে অলকবাবুকে আমার চিঠি দেখাতে পার।
ঈশ্বর তোমাকে শান্তি ও সুমতি দিন। –ইতি
অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ইচ্ছা করছে কাচের ডিনার সেটটা আছড়ে আছড়ে ভাঙি! হেরে গেছি, একেবারে নিঃশেষে হেরে গেছি। এরপর আর লোকসমাজে মুখ দেখাব কেমন করে? লোকসমাজে কেন–আয়নার সামনে দাঁড়াব আর কোন লজ্জায়? ঘরে-বাইরে দাঁড়াবার যে একটুখানি ঠাঁইও আমার রইল না। এমন অবস্থাতে পড়লেই কি মানুষ আত্মহত্যা করে বসে?
না। আত্মহত্যা আমি করব না। কিছুই খোয়া যায়নি আমার। অলককে বলব, লম্বা ছুটি নাও। চল, আমরা দুজনে কিছুদিনের জন্যে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। পর্ণার নাগপাশ থেকে ওকে উদ্ধার করতে হবে। পর্ণাকে তাড়াতে হবে ওর অফিস থেকে, ওর জীবন থেকে। কিন্তু!
পর্ণাকে ওর জীবন থেকে তাড়াতে পারলেই কি সব সমস্যার সমাধান হল? আজ যে আমি ঐ সঙ্গে নিজেকেও দেখতে পাচ্ছি। সুন্দরী স্ত্রীর একান্ত প্রণয় উপেক্ষা করে অলক যদি মরীচিকার পেছনে ছুটে থাকে তো তাকে দোষ দেব কেমন করে? আমিও তো ঐ পাপে পাপী! আমিও গৌতমের প্রেসে গিয়ে হাজির হয়েছিলুম ঐ একই প্রেরণায়। আমার মনে হয়েছিল, অলক যে সুনন্দার প্রেমে মুগ্ধ হয়েছে সে সুনন্দা আমার আমি নয়—সে একটা রক্ত-মাংস-চামড়ায় গড়া পুতুল। সে পুতুলটাকে আমি চিনিমাত্র। সে আমি নই। সে পুতুলটা সাজতে ভালবাসে, সাজাতে ভালবাসে, রোজ সন্ধ্যাবেলায় মাথায় গোলাপ ফুল গুঁজে সে কফির পেয়ালা হাতে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। জোলো প্রেম করে। সে কেক বানায়, উল বোনে, সামাজিক পার্টি-ডিনারে হাজিরা দেয়, অলক মুখার্জির স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করে। কিন্তু সে তো পুরোপুরি আমি নই। আমার মধ্যে যে সত্যিকার নারীসত্তাটা আছে তাকে তো অলক মুখার্জি কোনদিন ঘোমটা খুলে দেখবার চেষ্টা করেনি। সে-আমি যে প্রেমের ভরা বন্যায় নিঃসম্বল যাত্রায় প্রেমিকের হাত ধরে যাত্রা করতে রাজি; সে-আমি যে দয়িতের জন্য সব কৃসাধন হাসিমুখে স্বীকার করতে উন্মুখ। অলক মুখার্জি তো সে-আমিকে চিনবার চেষ্টা করেনি,—সে সুযোগও পায়নি সে। আমার সেই সত্তাই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঐ গৌতমের ছাপাখানার অফিসে। হ্যাঁ, আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার তখন মনে হয়েছিল, পারলে ঐ গৌতমই পারবে আমার সে প্রেমের মর্যাদা মিটিতে দিতে। ঠিকই ধরেছে সে। আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাইনি তার দ্বারে। আমি গিয়েছিলাম সেই প্রেরণায় যে প্রেরণাতে শ্রীরাধিকা ঘর ছেড়েছিলেন। কিন্তু সে কথা কোনোদিন জানতে পারবে না গৌতম; আমি নিজের কাছেও সে কথাটা এই মুহূর্তের আগে স্বীকার করিনি।
গৌতম লিখেছে, দাম্পত্য জীবনে সে সুখী! কেন লিখেছে? সেটা তো মিছে কথা। আমাকে আঘাত দেবার জন্যই লিখেছে। ভেবেছে, সে সুখী, একথা শুনলে আমি ঈর্ষার জ্বলে-পুড়ে মরব। কারণ তার বিশ্বাস, আমি তার কাছে গিয়েছিলাম শুধু বিশ্বাসঘাতকতা করতে। তার প্রতি ভালবাসার টানে নয়। এও তোমার ভুল, গৌতম। সে ভুল ভেঙে দেবার সুযোগও আমার আছে। কিন্তু তা আমি দেব না। তুমি সুখীই থাক। তোমার সুখেই আমার সুখ। উঃ! মাথার যন্ত্রণাটা আবার বাড়ছে।
চাকরটা এসে খবর দিল শম্ভুচরণবাবু এসেছেন।
শম্ভুবাবু আমার শ্বশুরের আমলের মানুষ।কারখানায় অলকের ডানহাত। শুনেছি আমার শ্বশুর যখন ফাঁকা মাঠের মাঝখানে এই কারখানা খুলবার স্বপ্ন দেখেন তখন সকলে তাকে বারণ করেছিল। এই শম্ভুচরণ তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বন্ধু ছিলেন দুজনে। তারপর অবশ্য শম্ভুচরণ বন্ধুর অধীনেই কাজ নেন। সেই অবধি তিনি রয়ে গেছেন এ কারবারে। অলক অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে তাকে। কর্মচারী হলেও তিনি যে পিতৃবন্ধু এ কথাটা আমার স্বামী ভুলতে পারে না। প্রতি বছরই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে তিনি এভাবে বাড়িতে এসেছেন বলে মনে পড়ে না
নেমে এলাম বাইরের ঘরে।
আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন শম্ভুবাবু। আমি তাড়াতাড়ি তার সম্মুখের সোফাটায় বসে বলি—কী খবর শ্যুকাকা, হঠাৎ এত রাতে?
ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে বলেন–মায়ের বিশ্রামের কি ব্যাঘাত ঘটালুম?
আমি বলি—মোটই না; কিছু জরুরি খবর আছে মনে হচ্ছে?
–তা আছে। কিন্তু তার আগে একটা কথা মা। আমাদের কথাবার্তা কি আর কেউ শুনতে পাচ্ছে?
আমি উঠে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এলাম। তার কাছে ফিরে এসে বসি; বলি–এবার বলুন।
বৃদ্ধ টাকের ওপর হাত বুলিয়ে আমতা আমতা করে বলেন–তোমাকে সব কথা খুলে বলব বলেই এসেছি মা।—কিন্তু স্বীকার করছি-সঙ্কোচও হচ্ছে একটু। তুমি কিছু মনে করবে না তো?
আমি বলি—মনে করার মত কথা না বললে, মনে করব কেন?
—কিন্তু মনে করার মতো কথাই যে বলব আমি, মা।
–তা হলেও বলুন।
আবার একটু ইতস্তত করে বলেন–আমার বরখাস্ত হয়ে গেছে, শুনেছ বোধকরি। চমকে উঠি আমি।বলি, কই, না?