ধর্মঘট আজ তিন দিনের শিশু!
কালও কোনোরকমে কাজ চলেছিল। আজ নাকি বয়লারে আগুন পড়েনি। রামলালের কাছে যা শুনলাম তা ভয়াবহ ব্যাপার। সমস্ত দিন স্তব্ধ গাম্ভীর্যে কারখানাটা যেন অপেক্ষা করে আছে–কালবৈশাখীর পূর্বাহে যেন বিশাল বনস্পতির মৌনতা।
কাল থেকে অলক বাড়ি ফেরেনি। কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যত কাজই থাক, রাতটা সে বাড়িতেই কাটায়। কাল গেছে একটা ব্যতিক্রম। টিফিন-ক্যারিয়ারে করে অফিসেই খাবার পৌঁছে দিয়ে এসেছে রামলাল। রাত্রে কেন ফিরলনা বুঝতে পারছি না। সারাটা রাত কী এমন কাজ থাকতে পারে? আজ সমস্ত দিনে পাঁচবার টেলিফোন করেছি। প্রতিবারেই শুনতে হয়েছে বড়সাহেব অফিসে নেই। অফিসে নেই তো কোথায় আছেন? সন্ধ্যাবেলায় আবার একবার ফোন করলাম—সেই একই জবাব—সরি, মিস্টার মুখার্জি এখন অফিসে নেই।
-কোথায় আছেন তিনি?
—বলতে পারছি না।
বিরক্ত হয়ে বলি-আপনি কে কথা বলছেন?
যেন প্রতিধ্বনি হল-আপনি কে কথা বলছেন?
ধমক দিয়ে উঠি–আমি মিসেস মুখার্জি, আপনি কে?
ধীরে ধীরে ওপাশ থেকে ভেসে এল-আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি মিস্টার মুখার্জির স্টেনো। মিস্টার মুখার্জিকে এখন পাবেন না।
কানে কে যেন সীসে ঢেলে দিল। টেলিফোনের এক প্রান্তে সুনন্দা মুখার্জি, অপর প্রান্তে পর্ণা রায়। মনে হল, ও যেন বলতে চায় অলককে আমি পাব কি না পাব তা নির্ভর করছে ওর মর্জির ওপর। আমি যেন একটা ভিক্ষা চাইছিলাম ওর কাছে–সেটাই প্রত্যাখ্যান করছে ও, স্পষ্ট ভাষায় বলছে-মিস্টার মুখার্জিকে এখন পাবেন না। মনে হল কথাটার মধ্যে প্রচণ্ড বিদ্রুপ আছে–কণ্ঠস্বর অনুসারে যেন ভাষাটা হওয়া উচিত ছিল-মিস্টার মুখার্জি কি আমার বাঁধা গরু, যে আঁচল খুলে দিলেই আপনার খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে?
ভীষণ একটা কড়া জবাব দিতে গেলাম। কী স্পর্ধা মেয়েটার, লাইন কেটে দিয়েছে।
সমস্ত সন্ধ্যাটা ছটফট করতে থাকি। সময় যেন আর কাটে না। সন্ধ্যার ডাকে এল একখানা চিঠি। হাতের লেখা অপরিচিত। ইচ্ছে করছে না খুলতে। মাথা ধরেছে আজ। কিন্তু হাতেও কোনো কাজ নেই। গল্পের বই পড়তেও ইচ্ছে করছে না। শেষপর্যন্ত খুলেই ফেললাম চিঠিখানা। আদ্যন্ত পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! চিঠি লিখেছে গৌতম। লিখেছে :
তোমার পাঠানো প্রফ পেলাম। বলেছিলে, আবার একদিন আসবে। এলে না। ভালই করেছ। যে কথা আজ চিঠিতে লিখছি, তা বোধহয় তোমার মুখের ওপর বলতে পারতুম না। তুমি বোধহয় খুব অবাক হয়ে গেছ আমার চিঠি পেয়ে, নয়? কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি জানতে না যে, আমি জানতুম-তোমার বর্তমান ঠিকানা। তোমার পরিচয়। অনেক দিনই জানি!
সেদিন তোমাকে দেখে যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম–তার কারণ শুধু এই। আমি ভাবছিলুম —ক্যাপিটালিস্ট অলক মুখার্জির স্ত্রী এ-বেশে, এ-ভাবে কেন এসেছেন আমার দ্বারে।
বারে বারে তা আমি জানতে চেয়েছিলুম। বারে বারে তুমি মিছে কথা বলেছিলে।
আমি তখন ভাবছিলাম—তোমার এই অদ্ভুত আচরণের দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমত তুমি এসেছিলে অলকবাবুর স্বার্থে। হয়তো তারই নির্দেশে এসেছিলে জানতে আমাদের কাগজের কথা। আমাদের আগেকার একটি সংখ্যার গ্যালি প্রুফ চুরি যায়। তাতে তোমার স্বামীর প্রভূত সুবিধা হয়েছিল। সেই জন্যই তোমাকে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বাস কর সু (এ নামে এই শেষ বার সম্বোধন করলুম তোমাকে, মাপ কর আমাকে) এ কথা মনে করতে সেদিন রীতিমতো কষ্ট হয়েছে আমার। যে মেয়েটির সঙ্গে একসঙ্গে রাত জেগে পোস্টার লিখতুম কলেজ জীবনে, স্বপ্ন দেখতুম পুঁজিবাদীদের শোযণের বিরুদ্ধে কাগজ বার করব বলে—সেই মেয়েটিই আসবে বন্ধুর বেশে বিশ্বাসঘাতকতা করতে–এটা ভাবতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমার স্বামী এবং আমি আজ ঘটনাচক্রে বিপক্ষ শিবিরে; তবু আমি ভাবতেই পারি না, তুমি আমার স্বার্থে তোমার স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পার, অথবা তার স্বার্থে আমার সঙ্গে।
তাই কিছুতেই ও কথাটা মেনে নিতে পারিনি।
সেদিন আমার স্ত্রীর কথা আলোচনা করিনি, আজ করছি। ঘটনাটা সমস্ত খুলে বলেছি আমার স্ত্রীকে। তাঁর বিশ্বাস, তুমি এসেছিলে শুধু ঐ কারণেই। শাঁখা-সিঁদুর সম্বল করে তুমি গুপ্তচরের বৃত্তিতে নেমেছিলে!
দেখ, স্পাই কথাটা শুনলেই কেমন যেন লাগে। তবু একটা আদর্শের জন্য, নিঃস্বার্থ দশের মঙ্গলের জন্য যখন মানুষ এই আপাতঘৃণ্য বৃত্তিতে নামে তখন তাকে ঘৃণা করা যায় না। স্বাধীনতা সংগ্রামের শত শহীদদের আমরা স্মরণ করি, কিন্তু আমি একটি মেয়েকে জানি যে বিপ্লবীদের পালিয়ে যাবার সুযোেগ দিতে স্বেচ্ছায় আত্মদান করেছিল দারোগাবাবুর কাছে। এক রাত আটকে রেখেছিল সেই নারীমাংসললালুপ পশুটাকে। স্বাধীনতার পরে যারা জেলে আটক ছিল তারা গদি পেল, পারমিট পেল, চাকরি পেল-পেল খেতাব আর সম্মান; কিন্তু ঐ একটি রাত যে হতভাগী দারোগাবাবুর ঘরে আটকে ছিল সে ঘর পেল না, বর পেল না-মা ডাক শুনল না জীবনে। তাকে ঘৃণা করি এত বড় নীতিবাগীশ
আমি নই?
কিন্তু আমার আশঙ্কা যদি সত্য হয়, তাহলে তোমাকে তো সে সম্মান দেওয়া যাবে না সু। তাই আজও বিশ্বাস করতে পারছি না–সেদিন তুমি এসেছিলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবার সদিচ্ছা নিয়ে।
আর একটি সমাধান হতে পারে এ সমস্যার। তুমি সেদিন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ছুটে এসেছিলে আমার কাছে অন্য এক প্রেরণায়। সেটা সামাজিক কারণে অন্যায় কি না জানি না। তবু হাজার বছরের কাব্য-সাহিত্য আমাদের শিখিয়েছে একে ক্ষমা করতে। প্রেম এমন একটা জিনিস যাতে অমার্জনীয় অপরাধেরও ধার ক্ষয়ে যায়। বিশ্বাস কর সু, আমি বিশ্বাস করেছিলুম—তুমি তারই প্রেরণায় ছুটে এসেছিলে আমার কাছে,তোমার স্বামীকে লুকিয়ে, তোমার পরিচয় গোপন করে।