০১.
আই চোজ মাই ওয়াইফ, অ্যাজ শী ডিড হার ওয়েডিং গাউন, ফর কোয়ালিটিস্ দ্যাট উড উয়্যার ওয়েল।—কথাটা গোল্ডস্মিথের। মানে, স্ত্রী যে মন নিয়ে বিবাহের বেনারসিটি কিনেছিলেন, আমিও ঠিক সেই মন নিয়েই আমার জীবন-সঙ্গিনীকে বেছে নিয়েছি—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল সেই গুণটি, অর্থাৎ–। দূর ছাই! সব ইংরেজি কথারই কি বাংলা করা যায়? অন্তত আমি তো পারি না। বাংলা ভাষাটার ওপর আমার তেমন দখল নেই। মনে হয়, সব কথা বাংলায় বোঝানো যায় না। মনের ভাবটা কাগজের বুকে কালির আঁচড়ে টানতে গেলেই তা এদেশের মৌসুমী ভিজে বাতাসে যেন স্যাৎসেতে হয়ে যায়। অথচ ঐ কথাই ইংরেজিতে বল, কোথাও বাধবে না।—গ্যালপে গ্যালপে এগিয়ে যাবে কলম। হয়তো ছেলেবেলা থেকে সাহেবদের স্কুলে পড়ে আমার এই হাল। সুনন্দা বেশ বাংলা বলে, সুন্দর চিঠি লেখে। বাংলা-অনার্সের ছাত্রী ছিল সে। যদিও শেষ পর্যন্ত অনার্স নিয়ে পাস করতে পারেনি, তবু ভাষাটা শিখেছে।
সে যা হোক–যে কথা বলছিলুম। সুনন্দাকে আধুনিক পদ্ধতিতেই বিবাহ করেছি। প্রথমে পরিচয়, পরে প্রেম ও পরিণামে পরিণয়! তবু মনে হয় নির্বাচনের সময় আমি তার বাহ্যিক দিকটার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলুম। বিলাতফেরত বড়লোকের একমাত্র পুত্রের, কোম্পানির একচ্ছত্র মালিকের স্ত্রীর যে গুণগুলি নিতান্ত প্রয়োজনীয়, সুনন্দার তার কোনোটারই অভাব ছিল না। তাই তাকে নির্বাচন করেছিলাম। ঠকিনি। বন্ধুবান্ধবেরা এখনও ঠাট্টা করে বলে–লাকি ডগ! চ্যাটার্জি সেদিন মশকরা করে বললে–তোমার নামের পেছনে বিলাতী অ্যালফাবেটের সঙ্গে আরও দুটো অক্ষর এখন থেকে বসাতে পার-এইচ. পি.।
আমি বললুম-এইচ. পি-টা কী বস্তু?
বলে–মিস্টার হেন-পেকড!
জবাব দিইনি। চ্যাটার্জি ও কথা বলতে পারে। ও হতভাগা সিউডো-ব্যাচিলার। স্ত্রী ওর সঙ্গে থাকে না। বেচারা।
সত্যিই পছন্দসই লক্ষ্মী বউ একটা…একটা অ্যাসেট। আর উড়নচণ্ডী দ্বিচারিণী হচ্ছে যাকে বলে, ব্যাঙ্ক-ক্র্যাশ! ঠিকই বলেছেন স্যেন্ম্যারেজ উইথ এ গুড উয়োম্যান ইজ এ হারবার ইন দ্য টেমপেস্ট অফ লাইফ; উইথ এ ব্যাড উয়োম্যান, ইট ইজ এ টেমপেস্ট ইন দি হারবার। অর্থাৎ
অর্থাৎ থাক। মোট কথা সুনন্দা আমাকে কানায় কানায় ভরে রেখেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানার কাজে ডুবে থাকি, সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারখানার কাজের চিন্তা আমার মনের সবটুকু দখল করে রাখে। সুনন্দার মতো সতী-সাধ্বী স্ত্রী না হলে আমার জীবনটা মরুভূমি হয়ে যেত। কী নিরলস পরিশ্রমে সে আমার কাছে কাছে থাকে। আমার প্রতিটি মুহূর্তকে মধুর করে তোলে। সময়ে চায়ের পেয়ালাটি, কফির কাপ, হাতে-গড়া কেক পুডিং যোগান দিয়ে যায়। সপ্তাহান্তে দুজনে সিনেমা যাই। রাত্রে নীচে ডানলোপিলো আর পাশে সুনন্দার নরম আশ্রয়ে ওর আবোল-তাবোল বকুনি শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি। স্ত্রীর কর্তব্যে সুনন্দা যেমন ত্রুটিহীন আমিও স্বামীর কর্তব্য সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন। আমাদের দাম্পত্য-জীবন ছককাটা ঘরে নিয়মের তালে তালে পা ফেলে চলে। এতটুকু বিচ্যুতি সহ্য করি না আমরা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে আমার সাতটা বাজে। এই সাতটা পর্যন্ত সুনন্দার ছুটি। ইচ্ছামতো সে বেড়াতে যায়, বই পড়ে, অথবা–অথবা কী করে তা অবশ্য আমি জানি না! অর্থাৎ জানবার চেষ্টা করিনি। কেন করব? সেটা স্বামী হিসাবে আমার অনধিকার চর্চা হয়ে যেত। সন্ধ্যা সাতটার পূর্ব মুহূর্তটি পর্যন্ত সময়টা তার পকেটমানির সামিল। সে যেমন খুশি তা খরচ করতে পারে। কিন্তু ঠিক সাতটার সময় আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন সে আমাকে রিসিভ করবার জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করে। প্রসাধন সেরে মাথায় একটি লাল গোলাপ গুঁজে একেবারে রেডি।
মাথায় লাল গোলাপ দেবার কথায় একটা পুরানো কথা মনে পড়ল। আমিই তাকে একদিন বলেছিলুম-প্রসাধনের পর খোপায় একটা লাল গোলাপ ফুল দিলে তাকে আরও সুন্দর দেখায়। তারপর থেকে প্রতিদিন সে এ কাজটি নিয়মিত করে।একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখলুম ওর খোপায় ফুল নেই। সেদিন অফিসের কী একটা গণ্ডগোলে এমনিতেই আমার মেজাজ খাপ্পা হয়ে ছিল। রাগারাগিটা বোধহয় বেশি করে ফেলেছিলুম। ওর এক বান্ধবী, নমিতা দেবী, বেড়াতে এসেছিলেন। তার সামনে ধমক দেওয়ায় সুনন্দা বড় অপমানিত বোধ করেছিল। রাত্রে নন্দা বললে–তুমি নমিতার সামনে কেন অমন করে বলে আমায়?
আমি বলি–তোমাকে আমার বলা আছে, সন্ধ্যাবেলায় মাথায় একটা গোলাপ ফুল দেবে। তোমার খোঁপায় ফুল না থাকলে আমার ভাল লাগে না। তুমি ফুল দিতে ভুল গেলে কেন আজ?
নন্দা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে–কী করব? আমাদের বাগানে আজ কোনো গোলাপ ফোটেনি যে।
ভাবলুম বলি—এ বাড়িতে একটি গোলাপ নিত্য ফুটে আছে দেখে গাছের গোলাপগুলো ফুটতে লজ্জা পায়। কিন্তু না, তাতে ওকে আশকারা দেওয়া হবে। কর্তব্যে অবহেলা করলে কঠোর হতে হয়।
তা সে অফিসের লোকই হোক অথবা বাড়ির লোকই হোক। কড়া সুরে বলি-লিঙ্কন। বলেছেন—নেভার এক্সপ্লেন। য়োর এনিমিজ ডু নট বিলিভ ইট অ্যান্ড য়োর ফ্রেন্ডস্ ডু নট নীড় ইট, অর্থাৎ–কাচ কৈফিয়ত দিও না, কারণ তোমার শত্রুরা তাহা বিশ্বাস করে না এবং তোমার বন্ধুদের তাহাতে প্রয়োজন নাই–
বাধা দিয়ে নন্দা বলে-থাক, অনুবাদ না করলেও বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু বাগানে ফুল না ফুটলে কী করে মাথায় ফুল দেওয়া যায় সে সম্বন্ধে চশার থেকে ইলিয়টের মধ্যে কেউ কখনও কিছু বলেছেন কি?