আমি বলি—বরং কাজের কথা বল শুনি। পত্রিকা কত ছাপছ? ফিনান্স কী রকম? বিজ্ঞাপন নেই দেখলাম। পাচ্ছ না, না নিচ্ছ না? কোনও ফিচার দিতে চাও?
গৌতম বলে–কাগজের কথা আজ আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না।
বলি-তাহলে তো মুশকিল। আমার স্বামীর কথা নয়, তোমার স্ত্রীর কথা নয়, তোমার প্রাকৃবিবাহ জীবনের ধ্রুবতারার কথা নয়, এমন কি কাগজের কথাও নয়। তাহলে কী আলোচনা করব আমরা? আজকের ওয়েদার? সিনেমা? রাজনীতি? ক্রিকেট খেলা?
গৌতম সে কথার জবাব না দিয়ে বলে—তোমাকে দেখে আজ আমি একেবারে অবাক হয়ে গেছি। সত্যি করে বলত সু, কেন তুমি এসেছ আমার কাছে?
বললাম—কী আশ্চর্য! সে তো আগেই বলেছি, চাকরির চেষ্টায়।
একটু চুপ করে থেকে গৌতম বলে–আমার বিশ্বাস হয় না। কেমন করে তুমি নেমে এলে এত নীচে?
–নেমে এলাম না উঠে এলাম?
গৌতম ধমক দিয়ে ওঠে-সিনেমার ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা কর না সু! এ দুনিয়ায় বাঁচতে হলে অর্থের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পার না তুমি। তোমার বাপের যথেষ্ট পয়সা ছিল। ভালো ঘরে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা–শিক্ষায়, বিদ্যায়, রূপে–
বাধা দিয়ে আমি বলি–এ যুগের ছেলেরা অন্ধ হলে আমি কি করতে পারি গৌতম? রূপের জাল তো বিস্তার করেও ছিলাম। কিন্তু জাল কেটে রুই-কাতলাগুলো বেরিয়ে গিয়ে যদি কাগজের সম্পাদক হয়ে বসে, তাহলে আমি কী করতে পারি?
লক্ষ্য করে দেখি, গৌতম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। একটা চোরকাঁটা দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে অন্যদিকে চেয়ে বসে আছে।
বলি—কী ভাবছ বল ত?
–একটা কথা সত্যি করে বলবে?
—বল না, কী কথা।
—কেন তুমি আজ এসেছ আমার কাছে? কী চাও তুমি সত্যি সত্যি?
ডায়েরি লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে—প্রশ্নটা কঠিন। অথচ কী তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। এখন নিজেকেই যদি ফের ঐ প্রশ্নটা করি, তাহলে নিজেকে কী কৈফিয়ত দেব? কেন গিয়েছিলাম আমি গৌতমের কাছে? দুঃসাহসিকার মতো! সে কি আমার অভিসার? ময়লা শাড়ি আর কাচের চুড়ি পরে একটি বেলা ওর সমতলে গিয়ে দাঁড়াবার সখ? যে জীবনকে পাইনি তাকে কয়েকটা খণ্ড-মুহূর্ত ধরে উপভোগ করবার ভাইকেরিয়াস তির্যক আস্বাদন? এ কি আমার প্রাচুর্যের হাত থেকে সাময়িকভাবে পালাবার জন্য এসকেপিজম? না কি সত্যিই গিয়েছিলাম গৌতমের কাগজের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতে? আমি অলকের যেমন ক্ষতি করতে পারি না, তেমনি সজ্ঞানে গৌতমেরও কি ক্ষতি করতে পারি? এত কথা তখন আমি ভাবিনি। মুখে-মুখে তৈরি জবাব দিয়েছিলাম–সে তো আগেই বলেছি, টাকার জন্য।
হয়তো বিশ্বাস করল গৌতম, হয়তো করল না। বলল, বেশ, তাই মেনে নিলুম। কিন্তু আজ আর নয়, এবার উঠতে হবে আমায়।
–আর একটু বস না।
–না, কাজ আছে। একজন লোকের আসার কথা আছে।
–গৌতম, প্লীজ।
তবুও উঠে পড়ে। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে-তোমার এ কথাটা ঠিক আগের কথার সঙ্গে খাপ খেল না। তুমি এসেছিলে টাকার জন্য। টাকা তোমাকে দিয়েছি, আরও দেব। কিন্তু অহেতুক সময় নষ্ট করে কী হবে বল?
মনে মনে হাসি। এ তাহলে অভিমান। যাক, ওর অভিমান ভাঙাবার সুযোগ পরে পাব। আপাতত আমিও উঠে পড়ি।
গৌতম বলে–আবার কবে আসছ?–কালই।
—না, কাল এস না। আমি থাকব না। তুমি বরং প্রুফটা ডাকে পাঠিয়ে দিও।
ও চলে যাবার উপক্রম করতে বললুম-আমার ঠিকানাটা তোমায় দিতে পারছি না, তবে এই ঠিকানায় চিঠি লিখলে আমি পাব।
নমিতার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে গুঁজে দিই ওর হাতে।
গৌতম চলে গেল। আশ্চর্য, একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।
০৫. এতদিনে নিঃসন্দেহ হয়েছি
এতদিনে নিঃসন্দেহ হয়েছি, এ ডেনমার্কে কোথাও কিছু একটা পচেছে। কিন্তু কোথায়? প্রথমে ভেবেছিলুম সেটা ফ্যাক্টরিতে, পরে মনে হল, না—সেটা আমার মনের ভেতর। এখন মনে হচ্ছে, তাও না–পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে সুনন্দার মনে। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কুমুদ।
যদি নিজের চোখেই আগে দেখা না থাকত তাহলে বিশ্বাস করতে পারতুম না। হয়তো বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে যেত। তবু আমাকে বিস্ময়ের অভিনয় করতে হয়—তুমি ভুল দেখেছ কুমুদ! তাই কখনও হয়?
কুমুদ অ্যাশট্রেতে চুরুটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললে—প্রথমটা আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু নমিতা আমার কাছে স্বীকার করেছে।
–কী স্বীকার করেছে? ও বেশে সুনন্দা কোথায় যায়?
–কোথায় যায় তা সে জানে না—কিন্তু যায়।
–ওকেই জিজ্ঞাসা করব?
চমকে ওঠে কুমুদ–পাগল! তাছাড়া নমিতা আমাকে বিশেষ করে বারণ করে দিয়েছে তোমাকে বলতে। তা সত্ত্বেও আমি বলতে বাধ্য হলুম। তোমাকে যে বলেছি, তাও নমিতার কাছে স্বীকার করব না আমি।
একটু চুপ করে থেকে বলি–তোমার কী মনে হয়?
কুমুদ বলে–আমার কী মনে হয় সে আলোচনা করার আগে বরং মিসেস মুখার্জি নমিতার কাছে যে কৈফিয়ত দিয়েছেন সেটাই বলি
–বল।
–মিসেস মুখার্জি নাকি তাঁর এক গরিব বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যান।
—দ্যাটস অ্যাবসার্ড! তাহলে আমার কাছে গোপন করবে কেন?
—ঠিক তাই। ও কথা নমিতাও বিশ্বাস করেনি, আমিও না।
–তাহলে?
—তাহলে স্টেটমেন্টটাকে একটু সংশোধন করতে হয়। ঐ বান্ধবীর স্ত্রীয়া ঈপটাকে বাদ দিতে হয়।
আমি চুপ করে থাকি।
কুমুদই ফের বলে–দেখ অলক, আমরা যে সমাজে বাস করি তাতে এ নিয়ে হৈ-চৈ করার কিছু নেই। আজ যদি আমি জানতে পারি নমিতা তার প্রাকবিবাহ জীবনের কোনো বন্ধুর সঙ্গে গোপনে দেখা করে তাহলে আমি সুইসাইড করব না। কিংবা আজ যদি মিসেস মুখার্জি জানতে পারেন তুমি তোমার লেডি-স্টেনোকে নিয়ে একটু ফুর্তি করেছ কোনও হোটেলে উঠে–