ঘরে আরও একজন লোক ছিল। বৃদ্ধ, চোখে চশমা। তাতে মোটা কাচ। সুতো দিয়ে বাঁধা কানের সঙ্গে। সেও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উপভোগ করলাম দৃষ্টিটা। হাতদুটি বুকের কাছে জড়ো করে বলি—এটাই কি দেওয়ালের লিখন কাগজের অফিস?
গৌতম কথা বলতে পারে না, প্রতি-নমস্কার করতেও ভুলে যায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোকই আমার কথার জবাব দেন—হ্যাঁ মা। কাকে খুঁজছেন?
—সম্পাদককে।
—ইনিই।
আমিই বসে পড়ি সামনের চেয়ারটায়।
–নমস্কার! আপনিই গৌতমবাবু?
গৌতম সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, কী চান?
–কাগজে আপনারা একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন দেখলাম–রীডার চাই। তাই—
বাধা দিয়ে গৌতম বলে—কাগজে বিজ্ঞাপন? কোন কাগজে?
এবার থতমত খেয়ে যেতে হয় আমাকে। একান্তভাবে আশা করেছিলাম, আমার মনগড়া কাহিনীটা গৌতম মেনে নেবে। অন্তত তৃতীয় ব্যক্তির সামনে এভাবে আমাকে জেরা করবে না। কী বলব ভেবে পাই না।
–কই, আমরা তো কোনো বিজ্ঞাপন দিইনি! কাটিংটা এনেছেন?
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম—কিন্তু–
একটা বিড়ি ধরিয়ে গৌতম বলে–মাপ করবেন। ঠিকানা ভুল হয়েছে আপনার। আমরা কোনো বিজ্ঞাপন দিইনি।
আমি উঠে পড়ি। সপ্রতিভভাবে বলি—তা হবে! বিরক্ত করে গেলাম, মাপ করবেন আমাকে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে গৌতম বলে–বিজ্ঞাপন দিইনি, কিন্তু প্রুফ-রীডারের সত্যিই প্রয়োজন আছে আমাদের। আপনি কি এর আগে প্রুফ-রীডিং করেছেন?
এবারে সত্যি কথাই বলি-কলেজ ম্যাগাজিনে এককালে করেছি। দুদিনেই শিখে নিতে পারব।
–অ। লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
আপাদমস্তক জ্বলে গেল আমার। সে কথার জবাব না দিয়ে বলি–এক গ্লাস জল পাব?
বৃদ্ধ শশবস্তে বলেন—নিশ্চয়ই। বসুন, দিচ্ছি।
যা ভেবেছিলাম তা হল না। বৃদ্ধকে স্থানত্যাগ করতে হল না। ঘরের ভেতরেই ছিল কুঁজো-গ্লাস। অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে জল এনে দিলেন তিনি।
গৌতম বলল–চা খাবেন?
–খেতে পারি।
–রতনবাবু, মোড়ের দোকান থেকে–
–এক্ষুনি আনছি স্যার—
বৃদ্ধ চলে যেতেই আমি ধমকে উঠি-সব জেনেশুনেও এভাবে আমাকে জেরা করার মানে?
গৌতম হেসে বলে—সব আর জানি কই? বড়লোকের মেয়ে; বি. এ. পাস করলে। বিয়ে করেছ–অথচ তোমার এই হাল!
বললাম–সব কথাই বলতে চাই। চাকরিটা হবে কিনা বল?
—সত্যিই চাকরির দরকার তোমার?
–এখনও সন্দেহ আছে?
–না। কিন্তু তোমার স্বামী–
–স্বামীর কথা থাক।
–তা না হয় থাক, কিন্তু আমার কাগজের যা আর্থিক অবস্থা—
কথাটা ওর শেষ হল না। বৃদ্ধ ফিরে এলেন দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে।
গৌতম বললেএর বেশি আমরা দিতে পারব না, আপনি রাজি?
বললাম–রাজি না হয়ে উপায় কী? তবে কাজ দেখে পরে না হয় কিছু বাড়িয়ে দেবেন।
–সে পরে দেখা যাবে। আপনি কি এখানে বসেই দেখবেন? প্রুফ দেব?
–আজ বরং নিয়ে যাই। কাল এনে দেব।
–বেশ রতনবাবু, তিন নম্বর পাতার গ্যালিটা এঁকে দিন।
রতনবাবু একগাদা কাগজ এনে দিলেন আমার হাতে।
চা খাবার পর গৌতম বৃদ্ধকে বলে—আমি একটু বের হব। যদি প্রকাশ আসে বসতে বলবে। আমি ঘন্টাখানেকের ভেতরেই ফিরে আসছি।
দুজনেই বেরিয়ে পড়ি অফিস থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি ফুটপাথ ধরে। একটু দূরে এসে বলি–মাত্র একঘন্টার সময় নিয়ে এলে?
গৌতম বলে—চল, ঐ পার্কটায় বসি।
—চল।
পার্ক ঠিক নয়। ফাঁকা মাঠ। এখনও বাড়ি ওঠেনি। বর্ষার জল জমে আছে এখানে ওখানে, তবু ওরই মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় দুজনে বসি। গৌতম বলে–তারপর? তোমার কী ব্যাপার? এ হাল হল কী করে?
বলি–সে তো দীর্ঘ ইতিহাস। বিয়ে করেছি সে তো দেখতেই পাচ্ছ। স্বামীর রোজগারটাও আন্দাজ করতে পার। আর কী জানতে চাও বল?
-বাবা বেঁচে আছেন?
–না।
–ভায়েরা দেখে না?
—দেখতে চাইলেও আমি দেখতে দেব কেন?
ল্যভ-ম্যারেজ? হেসে বলি–না, লোকসান-ম্যারেজ!–থাক কোথায়?
—ঐ প্রশ্নটার জবাব আমি দেব না।
–ভালো কথা, ফর্মা পিছু দু টাকা করে দেব তোমাকে। তাতে কুলোবে?
আমি আবার বলি-রাজি না হয়ে উপায় কী? তবে কাজ দেখে পরে না হয় কিছু বাড়িয়ে দেবেন। একটু ইতস্তুত করে গৌতম বলে—আজ কিছু আগাম নেবে?
মানিব্যাগ খুলে একটা দশ টাকার নোট বার করে। আমি বলি–না! একটা টাকাই দাও এখন! ফেরার ভাড়া। আর এ টাকাটাও আমি দান নিচ্ছি না। তোমার কাগজের নাম দিয়েছি আমি। এ তারই মজুরি।
গৌতম ম্লান হাসল।
বলি—তোমার খবর কী?
–কী খবর জানতে চাও?
–বিয়ে করেছ?
–করেছি।
হেসে বলি-বউ পছন্দ হয়েছে?
গৌতমও হেসে বলে–আমি যদি তোমার ভাষায় বলি—স্ত্রীর কথা থাক।
—আমি বলব, তা না হয় থাক।
গৌতম একটু ইতস্তত করে বলে—পর্ণার খবর জান?
হঠাৎ কেমন যেন রাগ হয়ে গেল আমার। বললাম—গৌতম, তুমি যদি চাও–তোমার স্ত্রী এবং আমার স্বামীর গল্পও করতে পার তুমি–কিন্তু ঐ মেয়েটির নাম আর আজকের সন্ধ্যাটায় নাই বা আলোচনা করলাম।
গৌতম হেসে বলে–তার মানে তুমি আজও তাকে হিংসে কর?
আমি বলি—না। তার মানে তুমি আজও তাকে ভুলতে পারনি।
গৌতম প্রতিবাদ করে না।
আর করে না বলেই আমার মনের সুর কেটে যায়।
বিরক্ত হয়ে বলি—কী যে তুমি দেখেছিলে ঐ মেয়েটার মধ্যে–
বাধা দিয়ে গৌতম বলে—কিন্তু এই মাত্র তুমি বললে আজ সন্ধ্যাটায় ওর কথা আমরা আলোচনা করব না।
আমি বিরক্ত হয়ে বলি-হ্যাঁ, তুমি চাও মুখে আমরা ওর কথা আলোচনা করব না। অথচ মনে মনে শুধু তুমি ওর কথাই ভাববে।
গৌতম আবার হেসে বলে–তুমি একটুও বদলাওনি। দি সেম ওল্ড জেলা ইয়াং লেডি!