আর পর্ণা? তার কথা তো জলের মত পরিষ্কার। গৌতম ব্যানার্জি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে কালনাগিনীর স্বরূপ। পাত্তা দেয়নি পর্ণাকে, তাই আজও মিস্ পর্ণা রায় চাকরি করে জীবনধারণ করছে। পর্ণা তাই গৌতমের ওপর প্রতিশোধ নিতে বসেছে। তার খবর গোপনে বেচে আসছে অলকের কাছে। এ কথা গৌতমকে জানিয়ে দিলে কেমন হয়? কিন্তু না। তাতে অলকের ক্ষতি।
ঠিক করলুম, অলককে অবাক করে দিতে হবে। যে কাজ পর্ণা পারে তা যে আরও সুচারুরূপে সুনন্দা পারে, এটা অলকের কাছে প্রমাণ করা চাই। না হলে এখানেও হার হবে আমার।
যে কথা সেই কাজ। পত্রিকা অফিসের ঠিকানাটা লিখে নিলাম এক টুকরো কাগজে। মতলব ঠিক করাই আছে। সোজা চলে গেলাম নমিতাদের বাড়ি। মনগড়া এক আষাঢ়ে গল্প শোনাতে হল তাকে। আমার এক গরিব বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাব। তাই ভাল শাড়িটা তার কাছে রেখে, গহনাপত্র খুলে রেখে যাব সেখানে। নমিতা বুদ্ধিমতী। বলে—বান্ধবী না হয়ে যদি বন্ধুই হয়, আমার আপত্তি কী?
আমি বলি—তোর মন ভারি সন্দেহবাতিক।
নমিতা হেসে বলে কিন্তু মিস্টার মুখার্জি কোথায়?
—আজ আসানসোলে গিয়েছে। কাল ফিরবে।
–তাই বুঝি আজ বান্ধবীকে মনে পড়েছে?
আমি আর কথা বাড়াতে দিই না।
বেলেঘাটার বাসে চেপে মনে হল–কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? আমাকে যদি এ বেশে কেউ দেখে ফেলে? আমাদের সমাজে বড় একটা কেউ বাসে চাপে না। সেদিক থেকে ভয় নেই। কিন্তু ওর কারখানার কত লোক আমাকে চেনে, যাদের আমি চিনি না। বাসের ঐ কোনায় ঐ যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন, তখন থেকে দেখছি উনি আমাকে লক্ষ্য করছেন। সে কি শুধু আমার রূপের জন্য? না কি আমার পরিচয় জানেন উনি? অবাক হয়ে ভাবছেন—মাথা খারাপ হয়েছে নাকি মিসেস্ মুখার্জির। কিন্তু না। অত শত ভাবতে গেলে আমার চলে না। আমি তো আমার যমজ বোনও হতে পারি। ওরা কি জানে, অলক মুখার্জির শালীকে দেখতে ঠিক তার স্ত্রীর মতো কিনা?
বাস চলেছে টিকিয়ে টিকিয়ে। ক্রমে লোকজনে বাসটা বোঝাই হয়ে গেল। নামব কী করে রে বাবা? ফুটবোর্ডে বাদুড়-ঝােলা হয়ে মানুষ ঝুলছে যে! কী করে বাসে-ট্রামে মেয়েরা যায়? শালীনতা রক্ষা করাই দায়।
বাসের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। বাইরে জনতার স্রোত। আজ ওদের সঙ্গে একটা একাত্মতা অনুভব করছি। আজ আমি ওদেরই একজন। আজ আমার পরনে সাধারণ মিলের শাড়ি, হাতে কাচের চুড়ি—গলায় প্যাক কোম্পানির মেকি হার, কানে পুঁতির দুল! আজ আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। চাকরি করি, রেশনের দোকানে লাইন দিই, সন্ধ্যাবেলায় ছোট-ছোট মেয়েদের নিয়ে অন্ধকার স্যাৎসেতে ঘরে প্রাইভেট টুইশানি করি।
–বেগবাগান, বেগবাগান!
একদল মানুষ নামছে, একদল উঠতে চাইছে। কী অমানুষিক প্রচেষ্টা! কেউ কারো তোয়াক্কা রাখে না। ধাক্কা দিয়ে, ঠেলা দিয়ে মানুষ উঠছে অথবা নামছে। আমিও কি নামবার সময় ও রকম কনুইয়ের তত মারব নাকি? পারব?
–টিকিট?
কন্ডাকটার এসে দাঁড়িয়েছে ভিড়ের মধ্যেও।
ছোট্ট হাত ব্যাগ খুলে বার করে দিই নোটটা, বলি—বেলেঘাটার মোড়ে নামব।
–তা নামুন না, কিন্তু দশ টাকার নোটের ভাঙানি নেই। খুচরো দিন।
–কত?
–পঞ্চাশ।
ব্যাগ হাতড়ে দেখি খুচরো মিলিয়ে বিশ পয়সার বেশি নেই।
কন্ডাকটার ধমকে ওঠে-ভাঙানি না নিয়ে ওঠেন কেন? এই ভিড়ে দশ টাকার ভাঙানি কোথায় পাই আমি?
কৌতূহলী জনতার দৃষ্টি এসে পড়ে আমার ওপর। নানা রকম মন্তব্য।—আহা, নেই বলছেন ভদ্রমহিলা, বিশ পয়সারই টিকিট দাও না ভাই।
–দয়া-দাক্ষিণ্য করার আমি কে স্যার? স্টেটবাস তো আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। ছাড়ব কোন আক্কেলে?
বৃদ্ধ ভদ্রলোক তবু আমার হয়ে সুপারিশ করেন—আহা মেয়েছেলে–
ও পাশ থেকে একজন অল্পবয়সি ছোকরা ফোড়ন কাটে—মেয়েছেলে বলে তো মাথা কেনেননি। বাসে-ট্রামে দশ টাকার নোট যে ভাঙানো যায় না তা জানা নেই ওঁর? আজই বাসে নতুন চড়েছেন নাকি?
আর একজন বলেন–এ এক চাল! টিকিট ফাঁকি দেওয়ার ফিকির!
বৃদ্ধ তবু আমতা আমতা করে বলেন—তবু, মেয়েমানুষ–
–আরে মশাই, আপনার অত দরদ কেন? বয়স তো অনেক হল দাদু!
শুধু আমার নয়, বৃদ্ধেরও কান লাল হয়ে ওঠে সে কথায়!
কন্ডাকটার তাগাদা দেয়–এক টাকার নোট নেই?
বাধ্য হয়ে বলতে হয়না! সবই দশ টাকার!
ছোকরা ফোড়ন কাটে–হায়! হায়! দেবী চৌধুরাণী রে! সবই মোহর।
ভেতরে ভেতরে জ্বলছি তখন আমি। কন্ডাকটরকে বলি—এই দশ টাকার নোটখানাই তুমি রাখ, ভাঙানি দিতে হবে না।
সবাই একটু হকচকিয়ে যায়।
বৃদ্ধ বলেন—সে কী! না হয় আমিই দিয়ে দিচ্ছি কটা পয়সা!
ছোকরা বলে–হ্যাঁ, ওঁর ঠিকানাও বরং জেনে নিন। একদিন পয়সাটা নিয়ে আসবেনএকটু চা-টাও খেয়ে আসবেন।
ও পাশের একজন ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বলেন–আঃ! কী হচ্ছে?
ছোকরা বলে-নভেল হচ্ছে দাদা! বাস টিকিটের ইতিকথা!
আমার স্টপেজ এসে গিয়েছিল। উঠে পড়লাম। ভিড় ঠেলে নেমে পড়ি বাস থেকে। জানলা গলিয়ে দশ টাকার নোটখানাই ছুঁড়ে দিই কন্ডাকটারকে। বলি—ভাঙানি হলে ঐ ছোকরাকে দিয়ে দিও। ওর অশ্লীল রসিকতার দাম।
বাস ছেড়ে দেয়।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তবু ঠিকানা খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছানো গেল সেই একতলার সৎসেতে ঘরখানায়।
দেওয়ালের লিখন পত্রিকার অফিস। ছোট্ট ঘর। দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। বিজলি বাতি। অসঙ্কোচে আরশোলা ঘুরছে টেবিলে, মেঝেতে। নড়বড়ে একটা টেবিল। হাতল-ভাঙা খানদুই চেয়ার। টেবিলের ওপর একরাশ কাগজ, ফ, মাটির ভাঁড়ে বিড়ির টুকরো। সামনের চেয়ারে বসে আছে যে। মানুষটি তাকে দেখলাম দীর্ঘদিন পর। চোখ তুলে সেও দেখল আমাকে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল!