এবারও আমি গিয়ে বসব ডায়াসে। এবার পরে যাব সবুজ রঙের নাইলনটা। পান্নার জড়োয়া সেটটা পরব সেদিন। মাথায় দেব জুইয়ের একটা মালা। আগে থেকে অলককে বলে রাখব, যেন পর্ণাকে নেওয়া হয় অভ্যর্থনা-কমিটিতে। পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ওকে। আমার পক্ষে তাকে চিনতে পারা শক্ত। কারখানায় কত কর্মী, আমি কী করে চিনব? পর্ণা নিশ্চয়ই স্তম্ভিত হয়ে যাবে! হঠাৎ বুঝতে পারবে–যে ধনকুবেরের অধীনে চাকরি পাওয়ার আশায় সে একদিন আবেদনে লিখেছিল—এই অসহায় দরিদ্র রমণীকে দয়া করে কাজটি দিলে প্রতিদানে কর্মক্ষেত্রে সে সকল শক্তি প্রয়োগ করবে—সেই অফিস-বস, সেই বড়সাহেবের সঙ্গে রীতিমতো লাভ-ম্যারেজ হয়েছে সুনন্দা মুখার্জির! মনিব-গিন্নি! কথাটা ভাবলেও হাসি পায়। পর্ণা নিশ্চয়ই গম্ভীর হয়ে যাবে। হঠাৎ মাথা ধরার অছিলায় সরে পড়তে চাইবে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার অজুহাত ছাড়া তার আর উপায় কী? কিন্তু ওগো পর্ণা দেবী! আলমগীর যে ভুল করেছিলেন আমি তা করব না! অসুস্থতার অজুহাতে তোমাকে আমার কারাগার থেকে পালাতে দেব না! সে না অভ্যর্থনা-কমিটির লোক! দায়িত্ববোধ নেই ওর? পর্ণাকে ডেকে বলব-আপনি বুঝি—; না–আপনি কেন? বলব–তুমিই বুঝি ওর স্টেনন? আই সী! এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াও না ভাই।বলব–আমার ড্রাইভারকে একটু ডেকে দাও না লক্ষ্মীটি—না না ব্যিউইকটা নয়-ওটা তোমার সাহেবের–আমার ড্রাইভার আছে আমার গাড়িতে—হ্যাঁ, ঐ কালো পন্টিয়াকটায়–থ্যাঙ্ক য়ু!
পর্ণা নিশ্চয়ই আজও জানে না, তার বড়সাহেবের মেমসাহেবটি কেমন মানুষ। রূপের প্রশংসা শুনে থাকবে সহকর্মীদের কাছে। নিশ্চয়ই তার কৌতূহল আছে প্রচণ্ড হয়তো বেচারি উদগ্রীব হয়ে আছে এই সুযোগে মনিব-গিন্নিকে একটু লুব্রিকেট করতে। চাকরি জীবনে অসহায় দরিদ্র রমণীর তোষামোদই তো উন্নতির একমাত্র সোপান। বিশ্বকর্মা পুজোর আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। অলকের ব্যস্ততার আর সীমা নেই। শুনেছি, ব্যস্ততার কারণ পুজো নয়–শ্রমিক য়ুনিয়ানের গণ্ডগোলের জন্যই। কিছুদিন হল শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটা খুব তিক্ত হয়ে উঠেছে। এরা মাঝে মাঝে ছাঁটাই করছে অবাঞ্ছিত শ্রমিক নেতাকে, ও পক্ষ করছে টোকেন-ধর্মঘট অথবা অবস্থান ধর্মঘট। অবস্থাটা ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে। অলক অবশ্য বারে বারে বলছে, শ্রমিক উপস্থিতির লালকালির দাগটা এখনো সমান্তরালই আছে-কিন্তু ও নাকি গোপনে সংবাদ পেয়েছে, চার্টের দাগটা যে কোনোদিন অতল খাদের দিকে হুমড়ি খেয়ে সোজা নেমে যেতে পারে। কিন্তু ভয় তো আমার ধর্মঘটকে নয়!
সেদিন বলেছিলাম—সন্ধ্যার পর বাড়িতে বসেই কাজ করলে পার?
ও বলে–কেন, ভয়টা কিসের? তোমার বান্ধবীকে তো? যখন তোমাদের সঙ্গে কলেজে পড়তেন তখন তার কী মূর্তি ছিল জানি না, কিন্তু এখন তার চেহারাটা যদি একবার দেখতে বুঝতে পারতে যে, তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই।
আমি বলি—আ হা হা! আমি যেন তাই বলছি!
ও আমাকে আদর করে বলে–যার ঘরের কোণে এমন ভরা পাত্র-ঝরনাতলার উছল পাত্রটার দিকে তার নজর যায় কখনও?
কী কথার ছিরি! আজকাল আবার মাঝে মাঝে বাংলায় উদ্ধৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাকে খুশি করার জন্য। এর চেয়ে ইংরেজি বুকনিও ছিল ভালো। অন্তত যা বলতে চায়, তার মানে বোঝ যায়। উপমান-উপমেয়ের তফাত যে বোঝে না—সে কেন এমনভাবে চাল দিয়ে কথা বলতে যায়? রবিবাবুর উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলার ফ্যাশন যেন একটা মুদ্রাদোষ আজকালকার ছেলেমেয়েদের!
কিন্তু যে কারণেই হোক, অলক শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেল আমার কাছে। ও স্বীকার করল, পর্ণাকে সে ব্যবহার করতে চায় কাঁটা তোলার কাজে। একখণ্ড সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখিয়ে বললে— মেয়েটা কাজের আছে। এই কাগজের অফিস থেকে এক শিট গ্যালি-প্রুফ চুরি করে এনেছে। কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি। চার পাতার একটা সাপ্তাহিক। বিজ্ঞাপন কিছুই নেই। ভাঙা টাইপ, খেলো কাগজ। প্রথম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা। অর্থাৎ যে ধরনের কাগজ নিত্য বের হয়, নিত্য বন্ধ হয়। কিন্তু আমার দৃষ্টি আটকে গেল সম্পাদকের নামটায়। সম্পাদক—গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমি ডুবে গিয়েছিলাম অতীতের আমিতে। অলকের কথা আর কানে যায়নি আমার। কলেজ জীবনে আমরা এই নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছি-আমরা একটা কাগজ বার করব। আমি আর গৌতম। আমি তার প্রুফ-রীডার-কাম ম্যানেজার, গৌতম তার পাবলিসিটি অফিসার-কাম এডিটর। আমাদের পুঁজি অল্প, কিন্তু আদর্শ বিরাট। বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করব না আমরা। মেহনতি মানুষদের কথা থাকবে তাতে। কৃষককে, শ্রমিককে যারা শোষণ করছে তাদের মৃত্যুবীজ বপন করে যাব আমরা ঐ কাগজে। হয়তো সে চারাগাছের মহীরুহ-রূপ দেখতে পাব না আমরা; কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল সে গাছ একদিন ফল দেবেই! আমাদের সেই কল্পলোকের পত্রিকার নামকরণ আমিই করেছিলাম-দেওয়ালের লিখন। আগামী দিনের হুঁসিয়ারি থাকবে আমাদের সেই কাগজে। যাদের চোখ আছে তারা পড়ে নাও–রাইটিং অন দ্য ওয়াল?
আশ্চর্য! সেই কাগজ এতদিনে বার করেছে গৌতম। আর তার চেয়েও বড় কথা, সে আমার দেওয়া নামটাই বজায় রেখেছে। তা রাখুক, তবু আমি বলতে বাধ্য-গৌতম আদর্শচ্যুত। লক্ষ্যভ্রষ্ট, ব্রাত্য সে। যারা সতিকারের সর্বনাশ ডেকে আনছে দেশের, কোটি কোটি টাকা ফরেন এক্সচেঞ্জ ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে গৌতমের কলম রুদ্ধবাক। তার যত তর্জন-গর্জন এই অলক মুখুজ্জেদের মতো চুনোখুঁটির ওপর। অলক ইনকাম ট্যাক্স কঁকি দেয় না, কালোবাজারি করে না, শ্রমিকের স্বার্থ সব সময়েই দেখে–তবু তার ওপরেই ওর যত আক্রোশ। কেন? সে কি জানে যে, তার সুনন্দাকে ছিনিয়ে নিয়েছে ঐ অলক? না, তা তো সে জানে না। জানার কথা নয়। তাহলে?