আমারও যেন সেই দশা!
দিব্যি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কেটে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘাড়ে যেন শনি চাপল। আমাকে বলল—ঐ দেখ, পথ দিয়ে অলক্ষ্মী যাচ্ছে, ওকে ডেকে নিয়ে এসো!
মনের মধ্যে সুবুদ্ধি বলে উঠল-ওরে, অমন কাজ করিস না। ও তোর সুখের সংসার ছারখার করে দেবে।
আমি তখন বধির হয়েছিলাম, সুবুদ্ধির উপদেশ আমি শুনিনি।
বড্ড বেশি বিশ্বাস করতাম অলককে। বড় গর্ব ছিল আমার। আমার ড্রেসিং-টেবিলের আয়নাটার ভেতর যে অপূর্বসুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে আমার নিত্য সাক্ষাৎ হয়, ওর ওপর বড় বেশি আস্থা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, ঐ ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার ও-প্রান্তে সন্ধ্যাবেলায় মাথায় গোলাপফুল গুঁজে যে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে রোজ মিটিমিটি হাসে, তার প্রেমে বুঝি পাগল হয়ে আছে অলক। একটা কালো কুৎসিত স্লেট-পেনসিলের সাধ্যও হবে না সে গ্রানাইট-প্রেমের গায়ে আঁচড় কাটতে।কিন্তু কেন এ কথা ভাবলাম? অসম্ভবকে কি ইতিপূর্বেই সম্ভব করেনি পর্ণা? গৌতমকে কি ছিনিয়ে নেয়নি আমার আঁচলের গিঁট খুলে?
কিন্তু কেন এসব ভাবছি পাগলের মতো? সবই হয়তো আমার কপোলকল্পনা। অলক তো বলছে, বিশ্বকর্মা পূজার আগে ঐ নোংরা একয়ে মজুরগুলো নাকি ধর্মঘট করতে চায়। এই জন্যই তার কাজ বেড়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে রোজ রাত হচ্ছে। হোক রাত, ও তো অফিসেই থাকে। সেটা পরীক্ষা করে জেনেছি। রাত নটা বাজলেই অফিসে টেলিফোন করি। সাড়া পাই। ও বলে, আর একটু দেরি আছে। পর্ণাও কি থাকে ওখানে অত রাত পর্যন্ত? জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হয়। কিন্তু থাকলেই বা কী? অফিসে আরও লোক থাকে, দোবেজী থাকে। হাজার হোক সেটা অফিস। অত ভয় কি আমার?
ভয় কি সাধে! আমি যে জানি, ও হচ্ছে–বিষকন্যা!
ও এসেছে আমার সুখের সংসারে আগুন দিতে।
সেদিন অলকের মন বুঝবার জন্যে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম-তুমি বলেছিলে পর্ণাকে একদিন বাড়িতে আনবে, কই আনলে না তো?
ও বললে-না, ভেবে দেখলাম সেটা উচিত হবে না। হতে পারে এককালে সে তোমার সঙ্গে পড়ত-কিন্তু এখন তোমার সঙ্গে তার আসমান-জমিন ফারাক। এই তফাতটা বজায় রাখাই ভালো। আর তা ছাড়া মেয়েটি খুব সুবিধেরও নয়, তোমার মুখের ওপরই বলছি-লাই দিলেই হয়ত মাথায় উঠতে চাইবে।
শুনে আশ্বস্ত হলাম। পর্ণাকে তাহলে ঠিকই চিনেছে ও। হাজার হোক অলক মুখার্জি গৌতম নয়! অত সহজে গলে যাবার মতো মাখনের মানুষ নয় সে।
তবু আমার মন যেন কাঁটা হয়ে থাকে। কোথাও কোনো ছায়া দেখলেই আমার মনে হয় এ বুঝি গ্রহণের পূর্বাভাস। বিষকন্যার বিষের নিশ্বাসের শব্দ যেন শুনতে পাই মাঝে মাঝে। কন্তু সামান্য কারণে আঁতকে উঠি। সেদিন গাড়ির ভেতর একটা সেন্ট-সুরভিত লেডিস-রুমাল কুড়িয়ে পেয়ে ঐভাবে, আঁতকে উঠেছিলাম। অলক যখন বললে যে, সে আমারই জন্য রুমালটা কিনেছিল–তারপরে কখন পকেট থেকে পড়ে গেছে জানে না, তখন নিশ্চিন্ত হই।
কিন্তু মদের মাত্রাটা আজকাল আবার বাড়িয়েছে। লক্ষ্য করেছি, যখনই ওর মনে দ্বন্দ্ব আসে ও মাত্রা বাড়ায়। আমার অসুখের সময় যেমন হয়েছিল। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়েছিল সেবার! এবার অবশ্য মাত্রা বাড়াবার সংগত কারণ আছে। শ্রমিক-ধমর্ঘট! কিন্তু অলক তো বারে বারে বলেছে, সে সব মিটমাট হয়ে যাবে। সেটুকু বিশ্বাস আমারও আছে। বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই সব মিটমাট হয়ে যাবে। পূজার পরেই এবার ছাঁটাই করতে বলব ওর স্টেনোকে। অলকই তো বলেছে অতি অপদার্থ মেয়েটা। কী দরকার ওকে রাখার? ওকে ডেকে এনেছিলাম একদিন সুযোগমতো অপদস্থ করব বলে—সেটা সেরে নেব এবার। বেশিদিন ওকে রাখা দুঃসাহসের কাজ হবে। সব কথা বরং অলককে খুলে বলি। দরকার হয় গৌতমের কথাও। বিয়ের আগে যদি গৌতমকে ভালবেসে থাকি–সে কি আমার অপরাধ? আজকালকার ছেলে-মেয়েদের প্রাকৃৰিবাহ জীবনের ইতিহাসে অমন এক-আধটা অধ্যায় থাকেই। শুনলে অলকের মূছা যাবার কোনো কারণ নেই। এত বছর ঘর করার পর এ নিয়ে নতুন করে মান-অভিমানের কোনো অর্থ হয় না। আর হলেও বাঁচি। অন্তত তাতেও এই একঘেয়ে জীবনে একটা বৈচিত্র্য আসবে। না হয় থাকলই দুদিন অভিমান করে। তবু সব কথা খুলে বলতে হবে–আর অনুরোধ করব, ঐ মেয়েটাকে ছাঁটাই করতে। অনুরোধ কেন? বাধ্য করব। আমার কথা ও কোনোদিন ঠেলতে পারে না, পারবেও না!
কিন্তু তার আগে বিশ্বকর্মা পুজো!
বছরে এই একটি দিন! শাড়ি-সজ্জার এক প্রদর্শনী। কারখানার মাঠে শামিয়ানা খাটিয়ে মঞ্চ করা হয়। সামনে গদি-আঁটা খানকয়েক চেয়ার খালি থাকে বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য। অভিনয় শুরু হওয়ার আগে হয় পুরস্কার বিতরণী। বাৎসরিক স্পাের্টসে যারা প্রথম-দ্বিতীয় হয়েছে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। মঞ্চের ওপর সাজানো থাকে নানান উপহার। গদি-আঁটা চেয়ারে আমাকে গিয়ে বসতে হয় মঞ্চের ওপর। পাদপীঠের জোরালো আলোয় ঝলমল করতে থাকে আমার সর্বাঙ্গ! একে একে নাম ডাকে কেউ। আমি হাতে তুলে দিই পুরস্কার। ওরা হাত পেতে নিয়ে যেন ধন্য হয়ে যায়। নত হয়ে নমস্কার জানায়। সে নতি, আমি জানি, শুধু কারখানার মালিকপত্নীকে নয়–সে নতি ওরা জানায় সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে। বার্ষিক স্পাের্টসে ওরা যে আপ্রাণ দৌড়ায়, লাফায়, সে কি শুধু ঐ পুরস্কারের লোভে? মোটেও নয়! দৌড়বার সময় ওদের মনে পড়ে এই মুহূর্তটির ছবি-যে মুহূর্তটিতে ওরা আসে আমার সেন্টসুরভিত সান্নিধ্যে, হাত পেতে প্রসাদ নিতে।