সিনেমা দেখাটাও! প্রতি রবিবারের সন্ধ্যাটি বন্দি থাকতে হয় রুদ্ধদ্বার কক্ষে! প্রাণান্তকর বিড়ম্বনা। কোনোদিন অসময়ে এসে বলেনি—দুখানা টিকিট কেটে এনেছি, চটপট তৈরি হয়ে নাও! অন্তত একথাও কোনোদিন বলেনি—এ রবিবার একটা জরুরি কাজ আছে আমার। এবার থাক লক্ষিটি, সোমবার নিয়ে যাব তোমাকে।
আমি যা চাই, তাই পাই। কিন্তু বড় হিসেবি সেই পাওয়াটা। বাঁধা পশুকে শিকার করায় আর যাই হোক শিকারের থ্রিল নেই! বাঁধা-মাইনেয় নেই সেই শিহরণ, যা পাওয়া যায় হঠাৎ-পাওয়া বোনাসে। আমি ভালবাসি মুখ বদলানো হিসাবে মাঝে মাঝে দাম্পত্য-কলহ হবে, ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধ ঘটবে, চলবে মান-অভিমানের পালা কয়েকটা দিন-তারপর হবে গভীরতর মিলন! কিন্তু যা চাই তা কি চেয়ে পাওয়া যায়? এ কথা কী বলে বোঝানো যায়? ভয় হয় বলতেও! ও যা মানুষ হয়তো বলে বসবে-বেশ তো, এবার থেকে প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আমি সব বিষয়ে ডিসেগ্রি করব তোমার সঙ্গে!
আপনারা হয়তো ভাবছেন বাড়াবাড়ি করছি। অলকের মতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান লোক এমন ছেলেমানুষি করতে পারে? পারে। বিশ্বাস না হয় শুনুন। একদিন আপত্তি করেছিলাম রবিবার সন্ধ্যায় সিনেমা যেতে, বললাম-আজ এসো দুজনে ছাদে গিয়ে গল্প করি।
ও বলল, সপ্তাহে একদিন আমোদ করা উচিত। আমাদের প্রোগ্রাম আছে রবিবারে সিনেমা যাওয়ার।
বললাম-বেশ তো নটার শোতে যাব।
-ওরে বাবা, রাত বারোটা পর্যন্ত আমি সিনেমা দেখতে পারব না। আর তা ছাড়া তুমি আমার সঙ্গে ঠিক ছটায় যাবে বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছ?
এত রুটিন-বাঁধা দাম্পত্য-জীবন ভালো লাগে তোমার?
এর উত্তরে কী বলল জানেন? ও বলল নাথিং ইন্সপায়ার্স কনফিডেন্স ইন এ বিজনেসম্যান সুনার দ্যান পাংচুয়ালিটি!—কথাটা ম্যাথুসের!
আপনারা বলতে পারেন এর উত্তরে আমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল–তোমার-আমার সম্পর্কটা কি বিজনেসের?
স্বীকার করছি, সে প্রশ্ন আমি করিনি। কারণ ওর সঙ্গে এতদিন ঘর করে বুঝেছি, এ কথা বললেই শুনতে হবে আর একটা জ্ঞানগর্ভ বাণী–বিবাহও যে একটা বিজনেস–একটা কন্ট্রাক্টমাত্র, সে সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত মুহূর্তে। শেক্সপীয়র, শ অথবা জেমস জয়েস–কে যে ওর পক্ষ থেকে সওয়াল করতেন তা জানি না, তবে এটুকু জানি যে, আমার যুক্তি যেত ভেসে!
তাই তো সেদিন যখন ওর জামা-কাপড় কাচতে দেওয়ার সময় পকেট থেকে দুটো সিনেমা টিকিটের কাউন্টারপার্ট বের হল তখন অবাক হয়ে গেলাম আমি। আরও অবাক হলাম এই জন্যে যে, টিকিট দুটি রাত্রের শোর! গত বৃহস্পতিবার রাত্রের। মনে মনে হিসাব করে দেখি, গত বৃহস্পতিবার রাত্রে নমিতার ননদের বিয়েতে গিয়েছিলাম। রাতে বাড়ি ফিরিনি। ও যায়নি, অফিসের কী জরুরি কাজের জন্যে। টিকিট দুখানা হাতে করে আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম। অলক মুখার্জি রাতের শোতে সিনেমা দেখেছে? বৃহস্পতিবার রাত্রে? যে বৃহস্পতিবার কাজের চাপে সে সামাজিক নিমন্ত্রণ রাখতে যেতে পারেনি সস্ত্রীক! সমস্ত দিন ছটফট করতে থাকি। কখন ও বাড়ি ফিরবে, কখন, ওকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হব। হঠাৎ মনে হল দ্বিতীয় টিকিটটা কার? ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই শিউরে উঠলাম। এমন প্রকাশ্যে চমকে উঠলাম যে, মলিনা ঘর মুছতে মুছতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—দিদিমণি যে জেগে জেগে দেয়ালা দেখছ গো!
মলিনা আমার বাপের বাড়ি থেকে এসেছে। অনেকদিনের লোক।
পুরানো খবরের কাগজটা খুলে দেখলাম, সেদিন ঐ হলে ফল অব বার্লিন বইটার শেষ শো হয়েছে। ওটা আর এখন কলকাতায় দেখানো হচ্ছে না। আমরা ওটা দেখিনি।
সন্ধ্যাবেলায় ও ফিরতেই প্রশ্নটা করলাম। সোজাসুজি না করে বললাম—এ রবিবার চল ফল অব বার্লিন দেখে আসি।
–বেশ।
–বইটা তোমার জানাশোনা কেউ দেখেছে নাকি? কী বলছে লোকে?
ও নির্বিকারভাবে বলল—তুমি জানো, সিনেমার খোঁজ আমি রাখি না।
-ও হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু বইটা তো তুমি নিজেই দেখেছ?
—আমি? কী বই? আমি টিকিটের ভগ্নাংশ দুটি ওর সামনে মেলে ধরে বলি, এই বই।
–ও সেই সিনেমাটা? সেই হিটলারের মতো দেখতে একটা জোকার আছে যেটাতে? হ্যাঁ ভালোই লেগেছে বইটা। চল না রবিবারে যাওয়া যাবে–
—কিন্তু তুমি তো দেখেছ সিনেমাটা!
–তাতে কী হয়েছে—না হয় আবার দেখব।
—তা তো বুঝলাম–কিন্তু এই জরুরি কাজেই বুঝি সেদিন রত্নার বিয়েতে যেতে পারলে না? হো হো করে হেসে ওঠে অলক। বলে—কথাটা তোমায় বলতে ভুলেই গেছি। সত্যিই জরুরি কাজ ছিল সেদিন। রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত কাজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। তারপর আর কাজ ছিল না। এক বন্ধু জোর করে ধরে নিয়ে গেল সিনেমায়। ঐটাই নাকি লাস্ট শো ছিল। তেমন করে ধরলে কী করি বল?
-ও! তেমন করে ধরলে বুঝি নাইট শোতেও সিনেমা দেখা যায়? তা এমন করে কোন বন্ধুটি তোমায় ধরল শুনি?
–সে তুমি চিনবে না। আমার একজন পোলিশ বন্ধু। আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ত গ্লাসগোতে। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পথে। ভারতবর্ষ দেখতে এসেছে। বলল—মুখার্জি, যুদ্ধটা আমরা কেমন উপভোগ করেছি চল দেখিয়ে আনি তোমায়। নিকলস্-এর সঙ্গে আলাপ হলে বুঝতে ওর কথা ঠেলা যায় না। সাড়ে ছফুট লম্বা ইয়া জোয়ান, শিশুর মতো সরল এদিকে।
বুক থেকে পাষাণভার নেমে যায়। নিজেকেই ধমক দিই—ছি ছি, কী ছোট মন আমার কেমন করে আমি ভাবতে পারলাম ও কথা? অলকের মন স্লেটের তৈরি নয় যে অত সহজেই আঁচড় পড়বে। সে মন শক্ত গ্রানাইটে তৈরি, সাধ্য কী পর্ণার যে সেই পাথরের ওপর দাগ কাটে?
০৪. কোথায় যেন গল্প শুনেছিলাম
কোথায় যেন গল্প শুনেছিলাম, একজনের মনের মধ্যে শনি প্রবেশ করেছিল। সে দেখলে, তার ঘরের সামনে দিয়ে একটি পরমাসুন্দরী মেয়ে যাচ্ছে। মেয়েটিকে সে বাড়িতে আনবার জন্যে আমন্ত্রণ করল। মেয়েটি বলে—তুমি আমাকে পথ থেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছ? কিন্তু শুনে রাখ বাপু, আমি হচ্ছি অলক্ষ্মী—যার সংসারে একবার আমি ঢুকি তাকে আমি ছারখার করে দিই।, লোকটি বলে—আমিও তাই চাই। জানো না, আমার শনির দশা চলেছে, আমার সুবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। এসো মা, আমার ঘরে এসো।