আর ওদের কোনও খবর পাইনি।
কালে থেমে গেছে কালযুদ্ধ। আশা করেছিলাম, রুদ্ধকারার এ পাশে এসে ওরা হাত মিলিয়েছে। আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করেছিলাম জীবনের ওই করুণ অধ্যায়টাকে।
অলকের কাছে তাই সেদিন মিস পর্ণা রায়ের দরখাস্তটা দেখে বুঝতে পারিনি প্রথমটা। ভাবতেই পারিনি ওদের বিয়ে হয়নি। নিঃসন্দেহ হলাম ফটোটা দেখে। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই চাপা হাসিটি লেগে আছে বিষাক্ত ঠোঁটের কোনায়। ফটোর মধ্যে থেকে ওর শ্বাপদ দৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে!
কিন্তু কাজটা কি ভালো করলাম? সত্যিই কি ওর উপকার করবার জন্য আমার প্রাণটা আকুল হয়ে উঠেছিল? তা তো নয়। মনের অগোচরে পাপ নেই। ওর নামটা দেখেই কেমন যেন মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ফটোটা দেখে আর আত্মসংবরণ করতে পারিনি। একদিন চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম—যুদ্ধ আর প্রেমের অভিধানে অন্যায় বলে শব্দটির স্থান নেই। ও বলেছিল—মনে থাকবে উপদেশটা। মনে রেখেছিল সে। কেড়ে নিয়েছিল শেষ পর্যন্ত গৌতমকে। নিজে অবশ্য পায়নি কিন্তু আমাকেও পেতে দেয়নি। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন। তাই কি আজ ইচ্ছা জেগেছে পার্বত্য-মূষিককে আমার রাজ-দরবারে হাজির করতে?
আজ অবশ্য মনের সে মেঘ সরে গেছে। আজ আমি পুরোপুরি সুখী। কী পাইনি আমি? এর চেয়ে কী বেশি দিতে পারত আমাকে গৌতম? অলকের চরিত্র গৌতমের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। ও আমাকে প্রাণ ঢেলে ভালবাসে। গৌতমের ভালবাসাও ছিল তীব্র; কিন্তু বোধ হয় নিখাদ ছিল না। তার প্রেম ছিল ঘড়ির দোলকের মতো। পর্ণা আর সুনন্দার মধ্যে প্রতিনিয়ত দুলত তার অস্থিরমতি ভালবাসা। আর আমার স্বামীর প্রেম যেন দিগদর্শন-যন্ত্র। জোর করে অন্য দিকে ফিরিয়ে দিলেও আমারই দিকে ফিরে আসবে তার একমুখী প্রেম।
তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, বুঝি মনের কোনো একটা কোণা খালি রয়ে গিয়েছে। কী-যেন পাওয়া হয়নি। কিসের যেন অভাব। বড় যেন ছককাটা জীবন আমাদের। গৌতমের সঙ্গে প্রায়ই আমার মতের মিল হত না। আমি যদি উত্তরে যেতে চাই–ও দক্ষিণমুখী রাস্তা ধরত। আমি যদি বলতাম এস গল্প করি, ও বলত–না, চল বরং সিনেমা যাই। আবার আমি যদি বলি–আজ সিনেমা যাব, ও সঙ্গে সঙ্গে বলে বসত—আজ বরং নদীর ধারে বেড়ানো যাক। মতের এই অমিলের মধ্য দিয়েই হত আমাদের মিল। ও ইংরেজি ছবি দেখতে পছন্দ করত—আমি ছিলাম বাংলা ছবির পোকা। এই নিয়ে আমাদের লেগে থাকত নিত্য খিটিমিটি। অলকের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার উপায় নেই—ওর কোনো ছবি ভালোও লাগে না, খারাপও নয়। অন্তত মতামত প্রকাশ করে না ভুলেও। জিজ্ঞাসা করলে বলে–তোমার কেমন লেগেছে? আমি ভালো-খারাপ যাই বলি, ও বলে–আমারও তাই। এক-একদিন কেমন যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু ও সব তাতেই সায় দিয়ে যায়। দুঃখ করে একদিন বলেই ফেলেছিলাম–তুমি আমার সব কথায় সায় দিয়ে যাও কেন বল তো? তোমার নিজস্ব কোনও মত নেই?
ও বলল——কেন থাকবে না, নিজস্ব মতোটা এ ক্ষেত্রে তোমার অনুকূলে।
রাগ করে বলি–এ ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই।
ও হেসে বলে—সেকথা ঠিক।
–কিন্তু কেন?
–শুনবে? তবে শোন–ইফ মেন উড কন্সিড়ার নট সো মাচ হোয়্যারিন দে ডিফার আজ হোয়্যারিন দে এগ্রি, দেয়ার উড বি ফার লেস অব আনচ্যারিটেনেস অ্যান্ড অ্যাংরি ফিলিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
এবার আমাকে বলতে হবে—-বেকন বলেছেন বুঝি?
আর ও বলবে—না এডিসন!
আচ্ছা, এইভাবে একটা মানুষ সারা জীবন কাটাতে পারে? জীবনে যা কিছু ভালবাসতাম সবই আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু ওগো নিষ্ঠুর ভগবান! এত সহজে, এত অপ্রতিবাদে, এত অনায়াসে আমাকে সব দিলে কেন? কিছু বাধা, কিছু ব্যতিক্রম, কিছুটা কঁকিও কেন রাখলে না তুমি? শাড়ি-গহনায় আমার লোভ ছিল এককালে–কিন্তু এমন বাক্সভরতি জিনিস তো আমি চাইনি। আমার দুঃখটা আমি বোঝাতে পারি না। নমিতাও অবাক হয়ে যায়–বলে, বুঝি না কী চাও তুমি সত্যি। কী করে বোঝাব?
এই তো সেদিন, আমি, নমিতা আর কুমুদবাবু মার্কেটে গিয়েছিলাম। নমিতার একটা মাইশোর জর্জেট পছন্দ হল, কিনতে চাইল। আপত্তি করলেন কুমুদবাবু। বললেন–এই তো সেদিন একটা ভাল শাড়ি কিনলে ওমাসে।নমিতা চুপ করে গেল। আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে ওঠে। ও কেন এমন করে আমার ইচ্ছায় বাধা দেয় না! ধমকও ও দেয়, কিন্তু সে আমার ইচ্ছাতে বাধা দিতে নয়—সে অন্য কারণে—কেন আমি রুটিন-বাঁধা পথে চলছি না, তাই। কেন মাসে মাসে নতুন শাড়ি কিনছি না, নতুন গহনা গড়াচ্ছি না, তাই! মার্কেট থেকে ফিরবার পথে নমিতা একটি কথাও বলল না–আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছিল ওকে। মনে হচ্ছিল–কী সৌভাগ্য নমিতার! এই শাড়ির ব্যাপার নিয়ে আজ রাত্রে ওদের মান-অভিমানের পালা চলবে—আর শেষ পর্যন্ত কুমুদবাবুকে হার স্বীকার করতে হবে। পরের দিন সেই শাড়িটিই কিনে এনে মান ভাঙাতে হবে নমিতার। অতটা না হলেও অন্তত ইংরেজি উদ্ধৃতি শুনতে হবে না নমিতাকে মধ্যরাত্রের নির্জনতায় এই অভিমানের জন্যে।
প্রসাধন জিনিসটা আমার চিরকাল ভাল লাগে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত আমার এককালে। আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আমার মাথা ধরে। রোজ সন্ধ্যাবেলা সেই তাসের দেশের হরতনের বিবিটি সাজতে সর্বাঙ্গ জ্বালা করে আমার! গোলাপ ফুল জিনিসটা যে এত কদর্য, তা স্বপ্নেও ভেবেছিলাম কোনোদিন?