আমি বললাম–সে কি তুমি বোঝ না? আমি বোধ হয় আমার একখানা হাত কেটে ফেলতে রাজি ছিলাম এ জন্যে।
ও চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে বলে–চললাম।
আমি বলি—সেকি! এরই মধ্যে?
–হ্যাঁ, কাল কলেজে দেখা হবে।
পরদিন কলেজে ঘটল একটা অদ্ভুত ব্যাপার। টিফিন-আওয়ার্সে আমাকে ডেকে পাঠালেন প্রিন্সিপ্যাল। বললেন–তোমাকে আমি ম্যাগাজিন-কমিটির সাব-এডিটর নমিনেট করেছি।
আমি চমকে উঠে বলি—সে কী স্যার, আমি তো ইলেকশনে হেরে গেছি। এখন আবার নমিনেশন কিসের?
প্রিন্সিপ্যাল গম্ভীর হয়ে বলেন—সব কথা তো বলা যাবে না, পর্ণা রিজাইন দেবে।
বুঝলাম সরকারি নির্দেশ এসেছে নিশ্চয়ই এই মর্মে। পর্ণার নাম লেখা আছে কালো খাতায়। কলেজ-ম্যাগাজিনে তাকে রাখা যাবে না। পেছনের দরজা দিয়ে এভাবে ঢুকতে আমার একটুও ইচ্ছে ছিল না—কিন্তু অধ্যক্ষের নির্দেশ এড়াতে পারলাম না। রাজি হতে হল আমাকে। য়ুনিয়ানের নব নির্বাচিত সভ্যদের মিলিত গ্রুপ ফটো ভোলা হল—আমাকে বসানো হল মধামণিরূপে প্রিন্সিপ্যালের পাশেই।
এর প্রায় দিনসাতেক পরে অপ্রত্যাশিতভাবে পর্ণা এসে দেখা করল আমার সঙ্গে। ওর দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
–আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।
—আমার সঙ্গে বেশ বলুন!
ও কিছুমাত্র ইতস্তত না করে বলে–আপনি গৌতমকে ছেড়ে দিন!
হো-হো করে হেসে উঠি আমি। এতদিনে মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে। ওর অপ্রস্তুত ভাবটা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করি, চিবিয়ে চিবিয়ে বলি-গৌতম কি আমার বাঁধা গরু যে, গেরো খুলে দিলেই আপনার খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে?
এক মুহূর্ত ও জবাব দিতে পারে না। তারপর সামলে নিয়ে বলে–আপনার কাছে এটা নিছক খেলা—কিন্তু আমার কাছে এটা কতটা মর্মন্তুদ তা আপনি আন্দাজ করতে পারেন না!
-কী করে পারব বলুন? আমার তো বুজ-ফ্রেন্ড নেই!
এবার বিশেষণের জ্বালাটা গলাধঃকরণ করতে হল ওকে বলল-আমি অযাচিতভাবে আপনার কাছে এসেছি—এভাবে অপমান করলেও অবশ্য আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু
মনে হল সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এটা। ভদ্রতায় বাধছে।
বললাম–কিন্তু আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন? অবশ্য আমার কাছে সাহায্য চাইতে আসার অধিকার আছে কিনা সেটা আপনারই বিচার্য।
ও বলল-এতদিন বলতে আসিনি। সম্প্রতি আমি আপনার একটা উপকার করেছি—এবং আমার দান আপনি অম্লানবদনে হাত পেতে গ্রহণ করেছেন, তাই বিনিময়ে আমার সাহায্য চাইবার অধিকার জন্মেছে বলেই বিশ্বাস করেছি আমি।
একটু অবাক হয়ে বলি—ঠিক বুঝলাম না তো, আপনি আমার কোন উপকারটা করেছেন?
—কলেজ-য়ুনিয়ানে সহ-সম্পাদিকার পদটা আপনাকে ছেড়ে দিয়েছি।
–ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলুন।
–হ্যাঁ, বাধ্য হয়েছি–কিন্তু সে তো আপনারই স্বার্থে।
–আমারই স্বার্থে। বলেন কী? প্রিন্সিপ্যাল কি আমারই স্বার্থে আপনাকে রিজাইন দিতে বাধ্য করেছিলেন?
-প্রিন্সিপ্যাল তো বলেননি।
-তবে?
—আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে গৌতম। কারণটা সে আমাকে বলেনি, শুধু বলেছিল আমি পদত্যাগ না করলে সে দুঃখিত হবে। কারণটা না বললেও সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম–আপনিও পেরেছেন আশা করি। তার অনুরোধই আমার কাছে আদেশ। তাই সরে দাঁড়িয়েছি আমি।
আমি বজ্রাহত হয়ে যাই। ছি ছি ছি! গৌতমের যদি এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান থাকে। এইভাবে সে আমাকে ঢুকিয়েছে কলেজ য়ুনিয়ানে! কোন লজ্জায় এরপরে কথা বলব পর্ণার সঙ্গে?
ও বলে—আপনি কি প্রতিদানে ছেড়ে দেবেন ওকে?
আমি বিরক্ত হয়ে উঠি–কী বকছেন ছেলেমানুষের মতো! আমি কি আঁচলে বেঁধে রেখেছি ওকে? এ কি কেউ ছেড়ে দিতে পারে? এ কেড়ে নিতে হয়।
ও এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে-এ যুদ্ধ-ঘোষণায় আপনার কোনও বীরত্ব নেই কিন্তু। যুদ্ধেরও একটা আইন আছে, সমানে সমানেই সেটা হয়ে থাকে। আপনি কি অন্যায় যুদ্ধ। করছেন না?
—অন্যায় যুদ্ধ মানে?
–মানে আপনার হাতে আছে ঈশ্বরদত্ত ব্রহ্মাস্ত্র; তপস্যা করে তা পাননি আপনি আপনার সহজাত কবচ-কুণ্ডল! আর আমি নিরস্ত্র। দুর্ভাগ্য আমার, গৌতমের চোখ আজ চকমকির ফুলঝুরিতেই অন্ধ।
–ঘিয়ের প্রদীপটার দিকে ওর নজর পড়ছে না, কেমন? কিন্তু সেজন্য আমাকে দোষ দিয়ে কী হবে বলুন? প্রদীপের কালির দিকে যদি গৌতমের নজর না পড়ে তবে তাকে দোষ দেবেন; এবং ঈশ্বর যদি আপনাকে রূপ না দিয়ে থাকেন তবে তার সঙ্গেই বোঝাপড়া করবেন। আর অন্যায় যুদ্ধের কথা বলছেন আপনি জানেন না, জীবনের দুটি ক্ষেত্রে আইন বলে কোনো কিছু নেই–
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ, তাই। দেয়ার্স নাথিং আনফেয়ার ইন ল্যভ অ্যান্ড ওয়র।
–ও আচ্ছা। মনে থাকবে উপদেশটা। নমস্কার!
–নমস্কার!
এর পর আর কোনোদিন কথা হয়নি পর্ণার সঙ্গে।
পর্ণা অবশ্য চেষ্টাই করেনি গৌতমকে ছিনিয়ে নিতে–আমার ইন্দ্রজালের মোহ ভেদ করে। সে জানত তা অসম্ভব। সর্বান্তঃকরণে সে নেমে পড়ল রাজনীতিতে। দিনরাত মেতে রইল ছাত্র আন্দোলনে। কাটল আরও মাসছয়েক। তারপর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার মাসখানেক আগে একটি ছাত্ৰ-শোভাযাত্রা পরিচালনা করবার সময় গ্রেপ্তার হল সে। লাঠি চার্জ করেছিল পুলিস। গুরুতর আহত অবস্থায় ভ্যানে করে তুলে নিয়ে গেল পর্ণাকে রাজপথ থেকে। গৌতম ততদিনে পাস করে কলকাতায় পড়তে গেছে য়ুনিভার্সিটিতে। পর্ণা আহত হওয়ার কথা শুনে সে ফিরে আসে। পুলিস-হাসপাতালে দেখা করতে যায় গৌতম। সেখানে তাদের কী কথাবার্তা হয়েছিল জানি না। কিন্তু সেখান থেকে সে বেরিয়ে এল–যেন একেবারে অন্য মানুষ। পর্ণা ছাড়া পেল না। পরীক্ষাও দেওয়া হল না ওর। বিনা বিচারে আটক হয়ে রইল। ক্রমে ক্রমে বদলে গেল গৌতমও। মাসতিনেকের মধ্যে তাকেও ধরে নিয়ে গেল পুলিসে।