টেনিদাই কথা কইল প্রথম।
—হাঁ রে, এটা কী হল বল দিকি?
হাবুল একটা চীনেবাদাম মুখে দিয়ে গিলতে গিয়ে বিষম খেল। খানিকক্ষণ খকখক করে কেশে নিয়ে বললে–এইটা আর বুঝতে পারলা না? সেই কদম্ব পাকড়াশি আমাগো পিছে লাগছে।
আমি বললুম—হয়তো বা কাগামাছি নিজেই এসে ছুঁড়ে দিয়েছে ওটা।
টেনিদা বলল–ধুত্তোর, এ তো মহা ঝামেলায় পড়া গেল! কোথায় গরমের ছুটিতে দিব্যি কদিন দার্জিলিঙে ঘুরে যাব, কোত্থেকে সেই মিচকেপটাশ লোকটা এসে হাজির হল। তারপর আবার সবুজদেড়ে সাতকড়ি সাঁতরা কী এক জাপানী বৈজ্ঞানিক কাগামাছি না বগাহাঁছি ভালো লাগে এসব?
হাবুল দুঃখ করে বললে– বুঝলা না, আমাগো বরাতই খারাপ। সেইবারে ঝণ্টিপাহাড়িতে বেড়াইতে গেলাম—কোঙ্কিা এক বিকট ঘুটঘুটানন্দ জুটল।
ক্যাবলা বললে–তাতে ক্ষেতিটা কী হয়েছিল শুনি? ওদের দলটাকে ধরিয়ে দিয়ে সবাই একটা করে সোনার মেডেল পাওনি?
টেনিদা মুখটাকে আলুকাবলির মতো করে বললে, আরে রেখে দে তোর সোনার মেডেল। ঘুটঘুটানন্দ তবু বাঙালী, যাহোক একটা কায়দা করা গিয়েছিল। আমি ডিটেকটিভ বইতে পড়েছি, এ-সব জাপানীরা খুব ডেঞ্জারাস হয়।
হাবুল মাথা নেড়ে বললে, হ-হ, আমিও পড়ছি সেই সব বই। আমাগো ধইরা-ধইরা পুটুত-পুটুত কইরা এক একখান ইনজেকশন দিব, আর আমরা ভাউয়া ব্যাঙের মতো চিতপটান হইয়া পইড়া থাকুম। তখন আমাগো মাথার খুলি ফুটা কইর্যা তার মইধ্যে বান্দরের ঘিলু ঢুকাইয়া দিব।
আমি বললুম—আর তক্ষুনি আমাদের একটা করে ল্যাজ বেরুবে, আমরা লাফ দিয়ে গাছে উঠে পড়ব, তারপর কিচমিচ করে কচিপাতা খেয়ে বেড়াব। আর আমাদের টেনিদা—
হাবুল বলল—পালের গোদা হইব। যারে কয় গোদা বান্দর।
ধাঁই করে টেনিদা একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে হাবুলের চাঁদির ওপর। দাঁত খিঁচিয়ে বললে–গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি? আমি মরছি নিজের জ্বালায় আর এগুলো সব তখন থেকে ফাজলামো করছে। অ্যাঁই—ভাউয়া ব্যাঙ মানে কী রে?
হাবুল বললে–ভাউয়া ব্যাঙ! ভাউয়া ব্যাঙেরে কয় ভাউয়া ব্যাঙ।
ক্যাবলা বিরক্ত হয়ে বলল—আরে ভেইয়া আব উস বাতচিত ছোড় দো, লেকিন টেনিদা, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।
–কী সন্দেহ শুনি?
—আমার মনে হল, ওই বুড়োটাই ছুঁচোবাজি ছেড়েছে।
আমরা তিনজনে একসঙ্গে চমকে উঠলাম।
—সে কী!
—আমার যেন তাই মনে হল। বুড়ো ওঠবার আগে নিজের পকেটটা হাতড়াচ্ছিল, একটা দেশলাইয়ের খড়খড়ানিও যেন শুনেছিলুম।
আমি বললুম—তবে বোধহয় ওই বুড়োটাই—
হাবুল ফস করে আমার কথাটা কেড়ে নিয়ে বললে– কাগামাছি।
টেনিদা মুখটাকে ডিমভাজার মতো করে নিয়ে বললে–তোদের মুণ্ডু। ও নিজেই যদি কাগামাছি হবে, তা হলে কাগামাছির নামে ভয় পাবে কেন? আর আমাদের ঝাউ বাংলোয় যেতে নেমন্তন্নই বা করবে কেন?
হাবুল আবার টিকটিক করে উঠল—প্যাটে ইনজেকশন দিয়া দিয়া ভাউয়া ব্যাঙ বানাইয়া দিব, সেইজন্য।
—ফের ভাউয়া ব্যাঙ! টেনিদা আবার হুঙ্কার ছাড়ল—যদি ভাউয়া ব্যাঙ-এর মানে বলতে না পারিস
—ভাউয়া ব্যাঙ-এর মানে হইল গিয়া ভাউয়া ব্যাঙ।
টেনিদা একটা লম্বা হাত বাড়িয়ে হাবুলের কান পাকড়াতে যাচ্ছিল, হাবুল তিড়িং করে লাফিয়ে সরে গেল-ভাউয়া ব্যাঙ-এর মতই লাফাল খুব সম্ভব। আর ক্যাবলা দারুণ বিরক্ত হল।
—তোমরা কি বসে বসে সমানে বাজে কথাই বলবে নাকি? ঝাউবাংলোতে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে না?
টেনিদা দমে গেল।
—যেতেই হবে?
ক্যাবলা বললে–যেতেই হবে। কদম্ব পাকড়াশি দুনম্বর চকোলেট পাঠিয়ে ভিতু বলে ঠাট্টা করে গেল, ছুঁচোবাজি ছেড়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ করলে, সেগুলো বেমালুম হজম করে চলে যাব? আমাদের পটলডাঙার প্রেটিজ নেই একটা?
আমি আর হাবুল বললুম—আলবাত!
—ওঠো তা হলে। বজ্ৰবাহাদুরের গাড়িটাই ঠিক করে আসি। কাল ভোরেই তো বেরুতে হবে।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি ভালো করে ঘুমুতে পারলুম না। রাত্তিরে মাংসটা একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে শরীরটা হাঁইফাই করতে লাগল। তারপর স্বপ্ন দেখলুম, একটা মস্ত কালো দাঁড়কাক আমার মাথার কাছে বসে টপটপ করে মাছি খাচ্ছে, একটা একটা করে ঠোক্কর দিচ্ছে আমার চাঁদিতে। আর ফ্যাকফ্যাক করে বুড়ো মানুষের মতো বলছে যাও না একবার নীলপাহাড়ি, তারপর কী হাঁড়ির হাল করি দেখে নিয়ো।
আঁকপাঁক করে জেগে উঠে দেখি, পুরো বত্রিশটা দাঁত বের করে হাবুল সেন দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটা সন্দেহজনক পেনসিল। তখন আমার মনে হল, দাঁড়কাক নয়, হাবুলই পেনসিল দিয়ে আমার মাথায় ঠোকর দিচ্ছিল।
বললুম—এই হাবলা কী হচ্ছে?
হাবুল বললে–চায়ের ঘণ্টা পইড়া গেছে। রওনা হইতে হইব না নীল-পাহাড়িতে? তরে জাগাইতে আছিলাম।
—তাই বলে মাথায় পেনসিল দিয়ে ঠুকবি?
হাবুলের বত্রিশটা দাঁত চিকচিক করে উঠল—বোঝস নাই, একসপেরিমেন্ট করতাছিলাম।
—আমার মাথা নিয়ে তোর কিসের এক্সপেরিমেন্ট শুনি?
—দেখতাছিলাম, কয় পার্সেন্ট গোবর আর কয় পার্সেন্ট ঘিলু।
কী ধড়িবাজ, দেখেছ একবার। আমি দারুণ চটে বললুম—তার চাইতে নিজের মাথাটাই বরং ভালো করে বাজিয়ে নে। দেখবি গোবর—সেন্ট পার্সেন্ট।
–চ্যাতস ক্যান? চা খাইয়া মাথা ঠাণ্ডা করবি, চল।
টেনিদা আর ক্যাবলা আগেই চায়ের টেবিলে গিয়ে জুটেছিল, আমি গেলুম হাবুলের সঙ্গে। চা শেষ না হতেই খবর এল, বজ্ৰবাহাদুর তার গাড়ি নিয়ে হাজির।
ক্যাবলা বললে–নে, ওঠ ওঠ। আর গোরুর মতো বসে বসে টোস্ট চিবতে হবে না।