—আমার বাড়িতে মিচকে আর ফচকে লোক তোমাদের নেমন্তন্ন করে বসেছে? আচ্ছা ফেরেব্বাজ তো। লোকটাকে ফাঁসি দেওয়া উচিত!
হাবুল বললে–তারে আপনি পাইবেন কই?
তখন সাতকড়ি সাঁতরা মিনিটখানেক খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ সেই বেঞ্চিটায় বসে পড়লেন। আর ভীষণ করুণ সুরে বললেন, বুঝেছি, সব বুঝতে পেরেছি এইবার।
আমরা চারজনে চেঁচিয়ে উঠলুম!–কী বুঝেছেন?
—এ সেই কদম্ব পাকড়াশির কাণ্ড।
—কে কদম্ব পাকড়াশি?
–আমার চিরশত্রু। যখন কবিতা লিখেছি, তখন কাগজে কাগজে আমার কবিতার নিন্দে করত! এখন সে বিখ্যাত জামানী বৈজ্ঞানিক কাগামাছির গুপ্তচর। আমার নতুন আবিষ্কৃত ফরমুলাগুলো সে লোপাট করে নিতে চায়। আমি বুঝতে পারছি ঝাউবাংলোর এক দারুণ দুর্দিন আসছে। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রক্তপাত। ওফ!
এক দারুণ রহস্যের সন্ধান পেয়ে আমরা চারজনে শিউরে উঠলুম। হাবুল সেন তো সঙ্গে-সঙ্গে এক চিৎকার ছাড়ল। টেনিদার মুখের দিকে দেখি, ওর মৈনাকের মতো লম্বা নাকটা কীরকম ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে, ঠিক একটা সিঙাড়ার মতো দেখাচ্ছে এখন। খানিকক্ষণ মাথা-টাথা চুলকে বললে–চুরি-ডাকাতি-হত্যা-রক্তপাত! এ যে ভীষণ কাণ্ড মশাই। পুলিশে খবর দিন।
পুলিশ! পৃথিবীর সবকটা মহাদেশের পুলিশ দশ বছর চেষ্টা করেও কাগামাছির টিকিটি ছুঁতে পারেনি। অবশ্যি কাগামাছির কোনও টিকি নেই-তার মাথা-জোড়া সবটাই টাক। নানা ছদ্মবেশে সে ঘুরে বেড়ায়। কখনও তিব্বতী লামা, কখনও মাড়োয়ারি বিজনেসম্যান, কখনও রাত্তিরবেলা কলকাতার গলিতে দুমুখো আলো হাতে মুশকিল আসান। পৃথিবীর সব ভাষায় কাগামাছি কথা কইতে পারে। শুধু তাই? একবার সে এক কাঁটাবনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, এমন সময় সেদিকে পুলিশ এসে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। ধরে ফেলে—এমন অবস্থা। তখন সেই ঝোপের মধ্য থেকে পাগলা শেয়ালের মতো খ্যাঁক-খ্যাঁক আওয়াজ করতে লাগল। পুলিশ ভাবল, কামড়ালেই জলাতঙ্ক–তারা পালিয়ে বাঁচল সেখান থেকে।
—তা হলে আপনি বলছেন সেই মিচকে চেহারার ফচকে লোকটাই কাগামাছি?আমি জানতে চাইলুম।
–না, ওটা কদম্ব পাকড়াশি। ওর মুখে একজোড়া সরু গোঁফ ছিল?
—ছিল। হাবুল পত্রপাঠ জবাব দিলে।
-আর গলায় একটা রোঁয়া-ওঠা মেটে রঙের ধুসো কম্ফর্টার?
—তাও ছিল।–এবার ক্যাবলাই সাতকড়িবাবুকে আলোকিত করল।
—তবে আর সন্দেহ নেই। ওই হচ্ছে সেই বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো হাড়-হাবাতে রাম-ফড় কদম্ব পাকড়াশি।
–তা হঠাৎ আপনার ওপরে ওদের নজর পড়ল কেন?—টেনিদা আবার জিগগেস করল।
হাবুল বললে–আহা শোন নাই? ওনার কী য্যান্ মুলার উপর তারগো চক্ষু পড়ছে।
টেনিদা বললে–মুলো? মুলোর জন্য এত কাণ্ড? আমাদের শেয়ালদা বাজারে পয়সায় তো একটা করে মুলো পাওয়া যায়। তার জন্যে চুরি-ডাকাতি-রক্তপাত? কী যে বলেন স্যার কোনও মানে হয় না।
সাতকড়ি সাঁতরা বিষম ব্যাজার হয়ে বললেন—মুলো কে বলেছে? মুলো আমার একদম খেতে ভালো লাগে না, খেলেই চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। আমি বলছিলুম ফরমুলা।
হাবুল বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললে–অ–ফরমুলা! তা ফরমুলার কথা ক্যাবলারে কন। আমাদের মধ্যে ও-ই হইল অঙ্কে ভালো—সব বুঝতে পারব।
—তোমরাও বুঝতে পারবে! আমি গাছপালা নিয়ে রিসার্চ করতে করতে এক আশ্চর্য আবিষ্কার করে বসেছি। অর্থাৎ একই গাছে এক সঙ্গে আমকাঁঠালকলা-আনারস-আপেল আর আঙুর ফলবে। আর বারো মাসেই ফলবে।
–তাই নাকি?—শুনে তো আমরা থ।
—সেইজন্যেই।–সাতকড়ি সাঁতরা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন।—সেইজন্যেই এই চক্রান্ত! ওহহ হহ! আমার কী হবে?
কিন্তু কিছুই ঠিক বোেঝা যাচ্ছে না। ক্যাবলাকে একটু সন্দিগ্ধ মনে হল। ফরমুলা চুরি করতে হলে সেটা তো চুপি চুপি করাই ভালো। সেজন্য পথেঘাটে এমন করে ছড়ার ছড়াছড়ি করার কী মানে হয়? সবই তো জানাজানি হয়ে যাবে।
—ওই তো কাগামাছির নিয়ম। গোড়া থেকেই এইভাবে সে রহস্যের খাসমহল তৈরি করে নেয়। বলতে-বলতে সাতকড়ি সাঁতরা প্রায় কেঁদে ফেললেন।—এই বিপদে তোমরা আমায় বাঁচাবে না? তোমরা এ-যুগের ইয়ংম্যান। এই দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়াবে না আমার?
এমন করুণ করে বললেন যে, আমারই বুকের ভেতরটা আ–আ-হা করতে লাগল। আর ফস করে টেনিদা বলে ফেলল—নিশ্চয় করব, আলবাত করব।
–কথা রইল।
–কথা রইল।
–বাঁচালে। বলে সাতকড়ি সাঁতরা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন—তা হলে আজ বিকেল সাড়ে-চারটেয় দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে। ন্যাচারাল মিউজিয়মের ওপরে যে-পার্কটা আছে সেখানে!
আর বলেই সুট করে কাঠবেড়ালির মতো পাশের বনটার ভেতর তাঁর সবুজ দাড়ি, ওভারকোট আর হাতের লাঠিটা নিয়ে ঠিক সেই মিচকেপটাশ কদম্ব পাকড়াশির মতোই হাওয়া হয়ে গেলেন তিনি।
০৪. চকোলেট নাম্বার টু
সবুজ দাড়ি, বাঁদুরে টুপি, নীল চশমা আর ধুসো ওভারকোট-পরা সাতকড়ি সাঁতরা তো সাঁ করে সিঞ্চলের সেই বনের মধ্যে টুপ করে ড়ুব মারলেন। আর কলকাতার কাকেরা যেমন হাঁ করে বসে থাকে, তেমনি করে আমরা চারজন এ-ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। শেষে হাবুল সেনই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। একটা খুদে পাহাড়ি মৌমাছি ওর কান তাক করে এগিয়ে আসছিল দেখে তিন পা নেচে নিয়ে মৌমাছিটাকে তাড়িয়ে দিলে।
হাবুল বললে– কাণ্ডটা কী হইল টেনিদা? টেনিদার মাথায় কোনও গভীর চিন্তা এলেই সে ফরাসী ভাষা শুরু করে। বললে– —ডি-লুক্স!
আমি বললুম-তার মানে?
টেনিদা আবার ফরাসী ভাষায় বললে–পুঁদিচ্চেরি!