ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে চারদিক তাকালেন। বললেন কী হয়েছে বলো দেখি? তোমরা সবাই আমাকে দেখে অমন ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? আর ওই যে কী বললে–ডিলা মেফিস্টোফিলিস—ওরই বা মানে কী? টেনিদা বললে–ওটা ফরাসী ভাষা।
ফরাসী ভাষা! ভদ্রলোক তার সবুজ দাড়ি বেশ করে চুমরে নিয়ে বললেন আমি দশ বছর ফ্রান্সে ছিলুম, এরকম ফরাসী ভাষা তো কখনও শুনিনি। আর মেফিস্টোফিলিস মানে তো শয়তান! তোমরা আমাকে বুড়ো মানুষ পেয়ে খামকা গালাগালি দিচ্ছ নাকি হে?
এবার মনে হল, ভদ্রলোক রীতিমতো চটেই গেছেন।
আমাদের ভেতর ক্যাবলাই সবচাইতে চালাক আর চটপটে, ও কিছুতেই কখনও ঘাবড়ে যায়। ও-ই সাহস করে ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে এল। বলল—আজ্ঞে আপনার দাড়িটা..
-কী হয়েছে দাড়িতে?
—মানে সবুজ দাড়ি আমরা কেউ কখনও দেখিনি কিনা, তাই–
–ওঃ এই কথা—ভদ্রলোক এবার গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন আর আমরা দেখতে পেলুম ওঁর সামনের পাটিতে একটা দাঁত নেই, আর একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। হাসির সঙ্গে সঙ্গে ওঁর নাক দিয়ে ফোঁতফোঁত আওয়াজ হল।
বেশ খানিকটা সোনালি দাঁতের ঝিলিক আর ফোকলা দাঁতের ফাঁক দেখিয়ে হাসি থামালেন। তারপর বললেন—ওটা আমার শখ। আমি একজন প্রকৃতি-প্রেমিক, মানে বন-জঙ্গল গাছপালা এইসব নিয়ে পড়ে থাকি। একটা বইও লিখছি গাছ-টাছ নিয়ে। তাই শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে ছন্দ মেলাবার জন্যে দাড়িটাকেও সবুজ রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি। বুঝতে পারলে?
টেনিদা হঠাৎ ফস করে জিগগেস করলে আপনি কবিতা লেখেন স্যার?
হাবুল বললে–হ-হ, আপনি পদ্য লিখতে পারেন?
—পদ্য? কবিতা?—ভদ্রলোকের মুখখানা আবার আহ্লাদে ভরে উঠল—তা লিখেছি বই কি এককালে। তোমাদের তখন জন্ম হয়নি। তখন কত কবিতা মাসিকপত্রে বেরিয়েছে আমার। এখন অবিশ্যি ছেড়েছুড়ে দিয়েছি। কিন্তু মগজে ভাব চাগিয়ে উঠলে মাঝে-মাঝে দুটো-চারটে বেরিয়ে আসে বই কি। এই তো সেদিন রাত্তিরে চাঁদ উঠেছে, পাইনগাছের মাথাগুলো ঝলমল করছে, আর আমি বসে বসে একটা ইংরেজী প্রবন্ধ লিখছি। হঠাৎ সব কী রকম হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি আমার কলমটা যেন আপনিই তরতর করে কবিতা লিখে চলেছে। কী লিখেছিলুম একটু শোনো–
ওগো চাঁদিনী রাতের পাইন–
ঝলমল করছে জ্যোৎস্না
দেখাচ্ছে কী ফাইন!
ঝিরঝির করে ঝরনা ঝরছে
প্রাণের ভেতর কেমন করছে
ভাবগুলো সব দাপিয়ে মরছে
ভাঙছে ছন্দের আইন–
ওগো পাইন।
–কী রকম লাগল?
আমরা সমস্বরে বললুম–ফাইন! ফাইন।
ভদ্রলোক আর একবার দাড়িটা চুমরে নিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আরও কোনও কবিতা বোধহয় তাঁর মাথায় আসছিল। কিন্তু ক্যাবলা ফস করে জিগগেস করলে আপনি মুণ্ডু নাচাতে পারেন?
–মুণ্ডু নাচাব? কার মুণ্ডু নাচাতে যাব আবার?
টেনিদা জিগগেস করলে—আপনি কুণ্ডুমশাই বুঝি?
–কুণ্ডুমশাই? আমার চৌদ্দপুরুষেও কেউ কুণ্ডুমশাই নেই। আমার নাম সাতকড়ি সাঁতরা। আমার বাবার নাম পাঁচকড়ি সাঁতরা। আমার ঠাকুর্দার নাম–
হাবুল বলে ফেলল—তিনকড়ি সাঁতরা।
সাতকড়ি অবাক হয়ে গেলেন—তুমি জানলে কী করে?
—দুইটা কইর্যা সংখ্যা বাদ দিতে আছেন কিনা, তাই হিসাব কইর্যা দেখলাম। আপনের ঠাকুদার বাবার নাম হইব এককড়ি সাঁতরা। তেনার বাবার নাম যে কী হইব—হিসাবে পাইতেছি না; মাইনাস দিয়া করন লাগব মনে হয়।
শাবাশ-শাবাশ!—সাতকড়ি সাঁতরা হাবুলের পিঠটা বেশ ভালো করে থাবড়ে দিলেন।—তোমার তো খুব বুদ্ধি আছে দেখছি। কিন্তু আমার ঠাকুর্দার কথা ভেবে আর মন খারাপ কোরো না—তাঁর নাম আমারও জানা নেই। যাই হোক, ভারি খুশি হলুম। আমি তোমাদের চারজনকেই ঝাউবাংলোয় নিয়ে যাব।
–ঝাউবাংলো!—ওরা তিনজনেই এক সঙ্গে লাফিয়ে উঠল।
–আহা! সেই কথাই তো বলছিলুম তোমার এই বন্ধুকে। আহা, কী জায়গা! দার্জিলিঙের মতো ভিড় নেই, চেঁচামেচি নেই, নোংরাও নেই। পাইন আর ঝাউয়ের বন। তার ভেতর দিয়ে সারি সারি ঝরনা নামছে। কত ফুল ফুটেছে এখন। শানাই, হাইড্রেনজিয়া, ফরগেট-মি-নট, রডোডেনড্রন এখন লালে লাল। আর আর তার মাঝে আমার বাংলো।
সাতকড়ি যেন ঘুমপাড়ানি গানের মতো সুর টেনে চললেন—তিনদিন যদি ওখানে থাকো, তা হলে তোমাদের মধ্যে যারা নিরেট বেরসিক, তারাও তরতর করে কবিতা লিখতে শুরু করে দেবে।
—কিন্তু তার আগে যদি ঝুমুরলাল চৌবে চক্রবর্তীর ছড়াটার মানে বোঝা যেত—
সাতকড়ি বললেন কী বললে–? ঝুমুরলাল চৌবে চক্রবর্তীর ছড়া? কী বিটকেল নাম! ও-নামে কেউ আবার ছড়া লেখে নাকি?
–আজ্ঞে লেখে, তাও আবার আপনার ঝাউবাংলোকে নিয়ে।
—অ্যাঁ।
–তাতে আপনার সবুজ দাড়ির কথাও আছে।
–বটে! লোকটার নামে আমি মানহানির মামলা করব।
টেনিদা বললে–তাকে আপনি পাচ্ছেন কোথায়? সেই মিচকেপটাশ লোকটা এক-একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। সে বলেছে, আপনার ঝাউবাংলোয় নাকি হাঁড়িচাঁচায় গান গায়।
সাতকড়ি চটে গেলেন—হাঁড়িচাঁচায় গান গায়? নীলপাহাড়িতে হাঁড়িচাঁচা কোত্থেকে আসবে? ও বুঝেছি। আমি মধ্যে-মধ্যে শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে থাকি বটে। তার নাম হাঁড়িচাঁচার গান? লোকটাকে আমি জেলে দেব।
—আরও বলেছে, সেখানে কুণ্ডুমশায় মুণ্ডু নাচায়।
—স্রেফ বাজে কথা। সেখানে কুণ্ডুমশায় বলে কেউ নেই। আমি আছি আর আছে আমার চাকর কাঞ্ছা। নিজের মুণ্ডু নাচানো আমি একদম পছন্দ করি না। কাঞ্ছাও করে বলে মনে হয় না আমার।
ক্যাবলা বললে–শুধু তাই নয়। আপনি বলার আগে সে-ই আমাদের ঝাউবাংলোয় নেমন্তন্ন করেছে।