আমরা উঠেছিলাম স্যানিটোরিয়ামে। হুল্লোড়ের এমন জায়গা কি আর দার্জিলিঙে আছে। পাহাড় ভেঙে ওঠানামা করতে এক আধটু অসুবিধা হয় বটে, কিন্তু দিব্যি জায়গাটি। তা ছাড়া খাসা সাজানো ফুলের বাগান, মস্ত লনে ইচ্ছে করলে ক্রিকেট ফুটবল খেলা যায়, লাইব্রেরির হলে টেবিল-টেনিস আর ক্যারামের বন্দোবস্ত। খাই-দাই, খেলি, ঘোড়ায় চড়ি, বেড়াই আর ফটো তুলি। এক বটানিকসেই তো শ-খানিক ছবি তোলা হল। এমনি করে চার-পাঁচদিন মজাসে কাটাবার পর একদিন ক্যাবলাটাই টিকটিক করে উঠল।
–দুৎ, ভালো লাগছে না।
আমরা তিনজন এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম।
—ভালো লাগছে না মানে?
-মানে, ভালো লাগছে না।
টেনিদা চটে বললে– কলেজে ক্লাস করতে পারছে না কিনা, তাই ওর মন খারাপ। এখানকার কলেজ তো ভোলাই রয়েছে। যা না কাল লজিকের ক্লাসে ঢুকে পড়।
ক্যাবলা বললে–যাও-যাও!
হাবুল সেন বললে–আমরা যামু ক্যান? আমরা এইখানে থাকুম। তর ইচ্ছা হইলে তুই যা গিয়া। যেইখানে খুশি।
ম্যালের বেঞ্চিতে বসে আমরা চারজনে চীনেবাদাম খাচ্ছিলুম, ক্যাবলা তড়াক করে উঠে পড়ল। বললে–তা হলে তাই যাচ্ছি। যাচ্ছি গাড়ি ঠিক করতে। কাল ভোরে আমি একাই যাব টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে।
টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে একখানা লম্বা হাত বের করে ক্যাবলাকে পাকড়ে ফেলল।
—আরে তাই বল, টাইগার হিলে যাবি। এ তো সাধু প্রস্তাব। আমরাও কি আর যাব না?
–না, তোমাদের যেতে হবে না। আমি একাই যাব। হাবুল গম্ভীর হয়ে বললে–পোলাপানের একা যাইতে নাই টাইগার হিলে। বাঘে ধইরা খাইব।
—ওখানে বাঘ নেই।–ক্যাবলা আরও গম্ভীর।
আমি বললুম–বেশ তো, মোটরের ভাড়াটা তুই একাই দিস। তোর যখন এত জেদ চেপেছে তখন না হয় একাই যাস। আমরা শুধু তোর বডিগার্ড হয়ে যাব এখন। মানে তোকে যদি বাঘে-টাঘে ধরতে আসে–
ক্যাবলা হাত-পা নেড়ে বললে–দুত্তোর, এগুলোর খালি বকরবকর। সত্যই যদি যেতে হয়, চলো এইবেলা গাড়ি ঠিক করে আসি, কদিন ধরে আবহাওয়া ভালো যাচ্ছে—বেশি মেঘ বা কুয়াশা হলে গিয়ে শীতে কাঁপাই সার হবে।
পরদিন ভোর চারটায় টাইগার হিলে রওনা হলুম আমরা। বাপ, কী ঠাণ্ডা। দার্জিলিঙ ঠাণ্ডায় জমে আছে। ঘুম স্টেশন রাশি রাশি লেপ কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমে অচেতন। শীতের হাওয়ায় নাক কান ছিঁড়ে উড়ে যাওয়ার জোর। ল্যান্ড রোভার গাড়ি, ঢাকাঢাকি বিশেষ নেই, প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি করে উঠল।
টেনিদা চটে বললে–ধুত্তোর ঘোড়ার ডিমের টাইগার হিল। ক্যাবলার বুদ্ধিতে পড়ে যত ভোগান্তি। একেবারে জমিয়ে দিলে।
হাবুল বললে–হ, আমাগো আইসক্রিম বানাইয়া ছাড়ব।
লেপ-টেপগুলো গায়ে জড়িয়ে এলে ভালো হত।—আমি জানালুম।
ক্যাবলা বললে–অত বাবুগিরির শখ যখন, কলকাতায় থাকলেই পারতে। পৃথিবীর কত দেশ থেকে কত লোক টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে আসে আর এইটুকু ঠাণ্ডায় ওঁদের একেবারে প্রাণ বেরিয়ে গেল!
—অ—এইটুকু ঠাণ্ডা। দাঁত ঠকঠকিয়ে টেনিদা বললে–!—এইটুকু ঠাণ্ডায় বুঝি তোর মন ভরছে না! আচ্ছা বেশ, কাল মাঝরাতে তোকে এক বালতি বরফ জল দিয়ে স্নান করিয়ে দেব এখন।
আমি বললুম—শরীর গরম করার বেস্ট উপায় হচ্ছে গান। এসো, কোরাসে গান ধরা যাক।
টেনিদা গজগজ করে কী যেন বললে, ক্যাবলা চুপ করে রইল, কিন্তু গানের নামে হাবুল একপায়ে খাড়া। দুজনে মিলে যেই গলা ছেড়ে ধরেছি : হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো অমনি নেপালী ড্রাইভার দারুণ আঁতকে হাঁই-হাঁই করে উঠল। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বললে–অমন বিচ্ছিরি করে চেঁচিয়ে চমকে দেবেন না বাবু। খাড়া পাহাড়ি রাস্তা—শেষে একটা অ্যাঁক্সিডেন্ট করে ফেলব।
কী বেরসিক লোক!
টেনিদা মোটা গলায় বললে– রাইট। গান তো নয় যেন একজোড়া শেয়াল কাঁঠাল গাছের তলায় বসে মরা কান্না জুড়েছে।
ক্যাবলা ফিকফিক করে হাসতে লাগল। আর আমি ভীষণ মন খারাপ করে বসে রইলুম। হাবুল আমার কানে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিয়ে বললে–তুই দুঃখ পাইস না প্যালা। কাইল তুই আর আমি নিরিবিলিতে বার্চ-হিলে গিয়া গান করুম। এইগুলান আমাগো গানের কদর কী বুঝব!
যাই হোক, টাইগার-হিলে তো গিয়ে পৌঁছানো গেল। সেখানে এর মধ্যেই বিস্তর গাড়ি আর বিস্তর লোক জড়ো হয়েছে। পাহাড়ের মাথায় সানরাইজ দেখার যে-জায়গাটা রয়েছে। তার একতলা-দোতলা একেবারে ভর্তি। আমরা পাশাপাশি করে দোতলায় একটুখানি দাঁড়াবার ব্যবস্থা করে নিলুম।
সামনের অন্ধকার কালো পাহাড়টার দিকে চেয়ে আছি সবাই। ওখান থেকেই সুর্য উঠবে, তারপর বাঁ দিকের ঘুমন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সাতরঙের মায়া ছড়িয়ে দেবে। রাশি রাশি ক্যামেরা তৈরি হয়ে রয়েছে। পাহাড় আর বনের কোলে থেকে-থেকে কুয়াশা ভেসে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
তারপর সেই সূর্য উঠল। কেমন উঠল? কী রকম রঙের খেলা দেখা দিল মেঘ আর কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে? সে আর আমি বলব না। তোমরা যারা টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখেছ, তারা তো জানোই; যারা দেখোনি, না দেখলে কোনওদিন তা জানতে পারবে না।
ক্লিক ক্লিক ক্লিক। খালি ক্যামেরার শব্দ। আর চারদিকে শুনতে পাচ্ছি, অপূর্ব! অদ্ভুত! ইউনিক।
টেনিদা বললে–সত্যি ক্যাবলাকে মাপ করা যেতে পারে। এমন গ্র্যান্ড সিনারি কোনওদিন দেখিনি।
ঠিক সেই সময় পাশ থেকে মোটা গলায় কে বললে–তাই নাকি? কিন্তু এর চেয়েও ভালো সিনারি দেখতে হলে নীল-পাহাড়িতেই যাওয়া উচিত তোমাদের।