আমার মগজের ভেতরে হঠাৎ যেন বুদ্ধির একটা জট খুলে গেল। তা হলে–তা হলে–
আমি তখুনি কানে কানে কথাটা বলে ফেললুম।
আর ক্যাবলা? মাটি থেকে একেবারে তিন হাত লাফিয়ে উঠল। আকাশ ফাটিয়ে আর্কিমিডিসের মতো চিৎকার করল—পেয়েছি—পেয়েছি!
কী পেয়েছিস? হাবুলের কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিল টেনিদা, চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কী পেলি হাতি না ঘোড়া? খামকা চেঁচাচ্ছিস কেন ষাঁড়ের মতো?
ক্যাবলা বললে–যা পাবার পেয়েছি। একেবারে দুইয়ে দুইয়ে চারচারে চার আট!
-মানে?
–সব জানতে পারবে পনেরো মিনিটের মধ্যেই। কিন্তু তার আগে প্যালাকেও কনগ্রাচুলেট করা দরকার। ওর ডিটেকটিভ বই পড়ারও একটা লাভ আছে দেখা যাচ্ছে। কলকাতায় ফিরেই ওকে চাচার হোটেলে গরম-গরম কাটলেট খাইয়ে দেব।
টেনিদা বললে–উহু উহু, মারা যাবে। ওর ওসব পেটে সইবে না। ওর হয়ে আমিই বরং ডবল খেয়ে নেব।
হাবুল মাথা নেড়ে বললে– সত্য কথা কইছ। আমিও তোমারে হেলপ করুম। কী কস প্যালা?
আমি মুখটাকে গাজরের হালুয়ার মতো করে চলতে লাগলুম। এসব তুচ্ছ কথায় কর্ণপাত করতে নেই।
১২. পুণ্ডরীক কুণ্ডু এবং রহস্যভেদ
ঝাউ বাংলোর কাছাকাছি এসে পৌঁছুতেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল। সামনের বাগানের ভেতরে কাস্থ যেন কী করছিল—আমাদের ফিরে আসতে দেখেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপরেই ভেতর দিকে টেনে দৌড়।
টেনিদা বললে–ও কী! আমাদের দেখে কাঞ্ছা অমন করে পালাল কেন!
ক্যাবলা বললে–পালাল না, খবর দিতে গেল!
–কাকে?
ক্যাবলা হেসে বললে– কাগামাছিকে।
হাবুল দারুণ চমকে উঠল।
—আরে কইতে আছ কী! কাঞ্ছা কাগামাছির দলের লোক?
–হুঁ। টেনিদা বললে–আর কাগামাছি লুকিয়ে আছে এই বাড়িতেই!
ক্যাবলা হেসে বললে–হ্যাঁ, সবাই আছে এখানে। কাগামাছি, বগাহাঁচি, দুধের চাঁছি—কেউ বাদ নেই।
টেনিদা গম্ভীর হয়ে বললে–ঠাট্টা নয় ক্যাবলা। ওরা যদি আমাদের আক্রমণ করে?
কী নিয়ে আক্রমণ করবে? ওদের সম্পত্তির মধ্যে তো একটা ভাঙা হুঁকো, একগাছা মুড়োঝাটা আর একপাটি কুকুরে-চিবুনো ছেড়া চটি। সে-আক্রমণ আমরা প্রতিরোধ করতে পারব।
-ইয়ার্কি করছিস না তো?
—একদম না। চলেই এসো না আমার সঙ্গে।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে ঝাউবাংলোর দোতলায় উঠে গেলুম। বাড়িতে কোথাও কেউ আছে বলে মনে হয় না। চারদিক একেবারে নিঝুম! কাঞ্ছা পর্যন্ত কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। টেনিদা খোঁড়াচ্ছিল বটে, তবু সেই ফাঁকেই এক কোনা থেকে একটুকরো ভাঙা কাঠ কুড়িয়ে নিলে।
আমি জিগগেস করলুম—ওটা দিয়ে কী হবে টেনিদা?
–ঝাঁটা আর কোর আক্রমণ ঠেকানো যাবে। ক্যা
বলা বললে– কিছু দরকার নেই। অনেক বড় অস্ত্র আছে আমার কাছে। এসো সবাই–
কী যে ঘটতে যাচ্ছে ক্যাবলাই শুধু তা বলতে পারে! আমি মনে-মনে কিছুটা আন্দাজ করছি বটে, কিন্তু এখনও পুরোটা ধরতে পারছি না। দুরু দুরু বুকে ক্যাবলার পেছনে-পেছনে চললুম আমরা। এন্তার গোয়েন্দা বই পড়েছি আমরা রামগড়ের সেই বাড়িতে আর ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে। এর মধ্যে আমাদের দুদুটো অভিযানও হয়ে গেছে, কিন্তু এবার যেন সবটাই কেমন বিদঘুটে লাগছিল। আর সাতকড়ি
নিশ্চয় সেই লোক? এখন আর আমার কোনও সন্দেহ নেই। আর ওই হ্যান্ডবিলটা–
ক্যাবলা বললে–এখানে।
দেখলুম সেই বন্ধ ঘরটার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যেটায় দুদুটো পেল্লায় তালা লাগানো! সাতকড়ি যাকে বলেছিলেন স্ট্যাকরুম—মানে যার ভেতর বাড়ির সব পুরনো জিনিসপত্র ডাঁই করে রাখা হয়েছে।
ক্যাবলা বললে– এই ঘর খুলতে হবে।
টেনিদা আশ্চর্য হয়ে বললে–এই ঘর? হাতি আনতে হবে তালা ভাঙবার জন্যে, আমাদের কাজ নয়।
ক্যাবলা মরিয়া হয়ে বললে–চারজনে মিলে ধাক্কা লাগানো যাক। তালা না খোলে, দরজা ভেঙে ফেলব।
ভাবছি চারজনে মিলে চার বছর মারো জোয়ান-হেঁইয়োলে ধাক্কা লাগলেও খোলা সম্ভব হবে কি না, এমন সময় কোত্থেকে নেহাত ভালো মানুষের মতো গুটিগুটি কাঞ্ছা এসে হাজির। যেন কিছুই জানে না, এমনি মুখ করে বললে–চা খাবেন বাবুরা? করে দেব?
তক্ষুনি তার দিকে ফিরল ক্যাবলা। বললচা দরকার নেই, এই ঘরের চাবিটা বার করো দেখি।
–চাবি? কাঞ্ছ আকাশ থেকে পড়ল!-চাবি তো আমি জানি না।
ক্যাবলা গম্ভীর হয়ে বললে– মিথ্যে কথা বোলো না কাঞ্ছা, ওতে পাপ হয়। চাবি তোমার প্যান্টের পকেটেই আছে। সুড়সুড় করে বের করে ফেলল।
কাঞ্ছা পাপ-টাপের কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল। মাথাটাথা চুলকে বললে–জু। চাবি আমার কাছেই আছে তা ঠিক। কিন্তু মনিবের হুকুম নেই—দিতে পারব না।
–তোমাকে দিতেই হবে!
কাঞ্ছা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল!–না, দেব না।
ক্যাবলা বললে–টেনিদা, কাঞ্ছা নেপালীর ছেলে, জান দিয়ে দেবে, কিন্তু মনিবের বেইমানি করবে না। কাজেই চাবি ও কিছুতেই দেবে না। অথচ, চাবিটা আমাদের চাই-ই। তুমি যদি পায়ের মচকানিতে খুব কাতর না হয়ে থাকো—তা হলে
ব্যস, ওইটুকুই যথেষ্ট। টেনিদাকে আর উসকে দেবার দরকার হল না। ডি-লা গ্রান্ডি বলেই তক্ষুনি টপাং করে চেপে ধরল কাকে, আর পরক্ষণেই কাঞ্ছার প্যান্টের পকেট থেকে বেরিয়ে এল চাবির গোছা।
কাঞ্ছা চাবিটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করল নির্ঘাত একটা দারুণ মারামারি হয়ে যাবে এবারে এই রকম আমার মনে হল। কিন্তু সে বিচ্ছিরি ব্যাপারটা থেমে গেল তক্ষুনি। কোথা থেকে আকাশবাণীর মতো মোটা গম্ভীর গলা শোনা গেল কাঞ্ছ, চাবি দিয়ে দাও, গোলমাল কোরো না।