ক্যাবলা বললে–দুত্তোর।
টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে–থাম।–দুত্তোর দুত্তোর করিসনি। পায়ে ভীষণ ব্যথা করছে কষ্ট হচ্ছে উঠে দাঁড়াতে। ওই যাচ্ছেতাই মাফলারটা দিয়ে আমার পাটা বেঁধে দে দিকিনি।
এতক্ষণ পরে হাবুল সেনের মাথাটা যেন সাফ হয়ে গেল একটুখানি। হাবুল বললে– হ-চিনছি তো। এই মাফলারটাই তো দেখছিলাম কদম্ব পাকড়াশির গলায়।
আমি বললুম-ঠিক-ঠিক।
টেনিদা বললে–তাই তো! আরে, এতক্ষণ তো খেয়াল হয়নি। সেই লোকটাই তো চকোলেট প্রেজেন্ট করে শিলিগুড়ি স্টেশনে আমাদের ঝাউ বাংলোয় আসতে নেমন্তন্ন করেছিল। আর সেই তো কাগামাছির চীপ অ্যাঁসিস্টান্ট-সাতকড়ি সাঁতার কী সব মুলোটুলো চুরি করবার জন্যে–
ক্যাবলা ততক্ষণে মাটিতে-পড়া গোটা দুই কাগজ কুড়িয়ে নিয়েছে। আমি দেখলুম, দুখানাই ছাপা কাগজ—হ্যাণ্ডবিল মনে হল। তাতে লেখা আছে :
শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে
বিখ্যাত গোয়েন্দা-লেখক
পুণ্ডরীক কুণ্ডুর
রহস্য উপন্যাস–??
পাতায় পাতায় শিহরন-ছত্রেছত্রে লোমহর্ষণ!
প্রকাশক :
জগবন্ধু চাকলাদার এন্ড কোং
১৩ নং হারান ঝম্পটি লেন, কলিকাতা—৭২
ক্যাবলার সঙ্গে সঙ্গে আমি আর হাবুলও হ্যান্ডবিলটা পড়ছিলুম। ওদিকে টেনিদা তখন তেমনি নিশ্চিন্ত হয়ে চকোলেট চিবিয়ে চলেছে, বিশ্ব সংসারের কোনও দিকে তার কোন লক্ষ আছে বলে মনে হল না।
পড়া শেষ করে ক্যাবলা বললে–এর মানে কী?
এইবার আমার পালা। ক্যাবলা ভারি বেরসিক ছেলে, ডিটেকটিভ বই-টই পড়ে না, বলে বোগাস। হাবুলের সমস্ত মন পড়ে আছে ক্রিকেট খেলায়—সেও বিশেষ খবর-টবর রাখে না। কিন্তু আমি? আমার সব কণ্ঠস্থ! রামহরি বটব্যালের রক্তমাখা ছিন্নমুণ্ড, কঙ্কালের হুঙ্কার, নিশীথ রাতের চামচিকে থেকে শুরু করে যদুনন্দন আঢ্যের কেউটে সাপের ল্যাজ, ভীমরুল বনাম জামরুল, অন্ধকারের কন্ধকাটা—মানে বাংলাভাষায় যেখানে যত গোয়েন্দা বই আছে সব প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছি। আর পুণ্ডরীক কুণ্ডু? হ্যা, তাঁর বইও আমি পড়েছি। তবে ভদ্রলোক সেরকম জমিয়ে লিখতে পারেন না, দাঁড়াতেই পারেন না রামহরি কিংবা যদুনন্দনের পাশে। কিন্তু তাঁর তক্তপোশের পোক্ত ছারপোকা আমার মন্দ লাগেনি। বিশেষ করে সেই বর্ণনাটা যেখানে হত্যাকারীর তক্তপোশের নীচে গোয়েন্দা হীরক সেন একটা মাইক্রোফোন লুকিয়ে ফিট করে রেখেছিলেন; হত্যাকারী ঘুমের ঘোরে কথা কইত, আর দু মাইল দূরে বসে গোয়েন্দা মাইক্রোফোনের সাহায্যে তার সব গোপন কথা শুনতে পেতেন।
দু নম্বর কাগজটাও ওই একই হ্যান্ডবিল! ক্যাবলা সেটাও একবার পড়ে নিলে। তারপর আবার বললে–এর মানে কী? এই হ্যান্ডবিল কেন? কে পুণ্ডরীক কুণ্ডু? জগবন্ধু চাকলাদার বা কে?
আমি বললুম-পুণ্ডরীক কুণ্ডু গোয়েন্দা বই লেখেন, কিন্তু ওঁর বই ভালো বিক্রি হয় না। আর জগবন্ধু চাকলাদার ওঁর পাবলিশার।
হুঁ। হাবুল ধুসো মাফলারটা নাড়াচাড়া করছিল, হঠাৎ উঃ বলে চেঁচিয়ে উঠে মাফলারটা ফেলে দিলে আর প্রাণপণে হাত ঝাড়তে শুরু করে দিলে।
আমি চমকে উঠে বললুম কী হল রে হাবুল? মাফলারের মধ্যে কী কোনও বিষাক্ত ইনজেকশন
—আর ফালাইয়া থো তোর বিষাক্ত ইনজেকশন! একটা লাল পিঁপড়ে আছিল, একখান মোক্ষম কামড় মারছে।
আহত পিঁপড়েটা তখন মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়ছিল। ক্যাবলা একবার সেদিকে তাকাল, তারপর আমার কোটের দিকে তাকিয়ে দেখল। কিছুক্ষণ কী ভাবল—মনে হল, কী যেন একটা গভীর রহস্যের সমাধান করবার চেষ্টা করছে।
তারপর বললে–তোর কোটেও তো দেখছি কয়েকটা মরা পিঁপড়ে লেগে আছে প্যালা!
বললুম–বাঃ! গাছে উঠে ওদের সঙ্গেই তো আমাকে ঘোরতর যুদ্ধ করতে হচ্ছিল।
–হুঁঃ। আচ্ছা ভালো করে চারদিকের ঝোপজঙ্গল লক্ষ্য করে দেখ তো, এরকম পিঁপড়ে এখানে আছে কি না!
এতক্ষণ পরে টেনিদা বললে– কী পাগলামো হচ্ছে ক্যাবলা। কাগামাছিকে ছেড়ে শেষে পিঁপড়ে নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করবি নাকি? উঃ, কদম্বটাকে ঠিক জাপটে ধরেছিলুম—একটুর জন্যে ক্যাবলা বললে–একটু থামো দিকি। কদম্ব আর পালাতে পারবে না, ঠিক ধরা পড়বে এবার। কী রে হাবুল, প্যালা, আর লাল পিঁপড়ে পেলি এখানে?
হাবুল বললে–না, আর দেখতে আছি না।
বলতে বলতে হাবুলের পিঠ থেকে কী একটা ঝোপের ওপর পড়ল। দেখলুম, সেই পচা ডিমের খোলার একটা টুকরো।
হাওয়ায় সেটা উড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্যাবলা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সেটাকে ধরে ফেলল। একমনে কী যেন দেখেই সেটাকে রুমালে জড়িয়ে বুক-পকেটে পুরে ফেলল।
টেনিদা বললে–ও আবার কী রে! পচা ডিমের গন্ধে প্রাণ যাচ্ছে গিয়ে জামাকাপড় ছাড়তে পারলে বাঁচি, তুই আবার সেই ডিমের খোলা কুড়িয়ে নিচ্ছিস।
ক্যাবলা সেকথার জবাব দিলে না। বললে–টেনিদা, উঠতে পারবে?
—পারব মনে হচ্ছে! ব্যথাটা কমেছে একটুখানি।
—তবে চলো। আর দেরি নয়।
—কোথায় যেতে হবে?
–ঝাউবাংলোয়। এক্ষুনি।
আর সাঁতরামশায়? যদি তেনারে এর মইধ্যে কাগামাছি একেবারে লোপাট কইর্যা ফ্যালায়?—হাবুল সন্দিগ্ধ হয়ে জানতে চাইল।
—আরে, কাগামাছি কো বাত আভি ছোড় দো! আগে ঝাউবাংলোয় চলল। সব ব্যাপারগুলোরই একটা কু পাওয়া যাচ্ছে মনে হয়—শুধু একটুখানি বাকি। সেটা মেলাতে পারলেই–
–আর তখুনি একটা কথা আমার মনে পড়ল। বড় বড় লেখকের অটোগ্রাফ জোগাড় করবার বাতিক আছে আমার, সেই সুবাদে আমি বছর তিনেক আগে একবার পুণ্ডরীক কুণ্ডুর সালকিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলুম। একটা জলচৌকির উপর উবু হয়ে বসে পুণ্ডরীক তামাক খাচ্ছিলেন, গলায় একটা ঢোলের মত মস্ত মাদুলি দুলছিল। ছবিটা চোখের সামনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। গোয়েন্দা-গল্পের লেখক, অথচ শার্লক হোমসের মতো পাইপ খান না।বসে বসে হুঁকো টানেন আর তাঁর গলায় ঘাসের নীলচে রংধরা একটা পেতলের মস্ত মাদুলি থাকে, এটা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। কিন্তু সবটা এখন নতুন করে মনে জাগল, আর সেই সঙ্গে