এসব বাজে লোকের বাজে কথায় কান দিতে নেই। কিন্তু মনিহারি থেকে চটেই ছিল টেনিদা। গাঁ-গাঁ করে বলল—আপনার মতো লোকের সঙ্গে আমরা কোথাও যেতে চাই না।
লোকটা কি বেহায়া! এবারে দাঁত বের করে হাসল। আমরা দেখতে পেলুম, লোকটার উঁচু-উঁচু দাঁতগুলো পানের ছোপ লাগানো, তার দুটো আবার পোকায় খাওয়া।
—যাবে না কেন? বাসে বিস্তর জায়গা রয়েছে, উঠে পড়ো।
—না।
–না কেন?—তেমনি পানে রাঙানো পোকায় খাওয়া দাঁত দুটো দেখিয়ে ফচকে লোকটা চোখ কুঁচকে হাসল। অ-রাগ হয়েছে বুঝি? তা রেলগাড়িতে ওঠানামার সময় অমন দুচারটে কথা কাটাকাটি হয়েই থাকে! ওজন্যে কিছু মনে করতে নেই। তোমরা হচ্ছ আমার ছোট ভাইয়ের মতো, আদর করে একটু কান-টান মলে দিলেই বা কী করতে পারতে? এসো খোকারা, উঠো এসো। আমি তোমাদের পথের সিনারি দেখাতে-দেখাতে নিয়ে যাব।
অস্পর্ধা দেখ, আমাদের কান মলে দিতে চায়। লোকটা বাসে চেপে না থাকলে নির্ঘাত টেনিদার সঙ্গে হাতাহাতিই হয়ে যেত। টেনিদা চিৎকার করে বলল শাট আপ।
লোকটা এবার হি-হি করে হাসল।
—গেলে না তো আমার সঙ্গে? হায়, তোমরা জানো না, তোমরা কী হারাইতেছ!
—আমরা জানতে চাই না।
ভোঁপ ভোঁপ শব্দ করে বাসটা ছেড়ে দিলে। লোকটা গলা বাড়িয়ে আবার বললে–তোমাদের একটা চকোলেট প্রেজেন্ট করে যাচ্ছি। হয়তো পরে আমার কথা ভাববার দরকার হবে তোমাদের। তখন আর এত রাগ থাকবে না।
বলতে বলতে কী একটা ছুঁড়ে দিলে আমাদের দিকে আর পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাবের উইকেটকিপার ক্যাবলা নিছক অভ্যাসেই সেটা খপ করে ধলে ফেলল।
চকোলেটই বটে! পেল্লায় সাইজের একখানা!
ক্যাবলা বলল—এটা ফেলে দিই টেনিদা?
চটে গেলেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে টেনিদার ভুল হয় না। ঝাঁ করে চকোলেটটা কেড়ে নিল ক্যাবলার হাত থেকে। মেজাজ চড়েই ছিল, একেবারে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল।
–ইঃ, ফেলে দেবেন! অত বড় একটা চকোলেট ফেলে দিতে যাচ্ছেন। একেবারে নবাব সেরাজদ্দৌল্লা এসেছেন। এটা আমার। আমিই তো ঝগড়া করে আদায় করলুম।
—আমরা ভাগ পামু না টেনিদা?-হাবুল সেন জানতে চাইল।
টেনিদা গম্ভীর হল!—পরে কনসিডার করা যাবে।-বলে চকোলেটটা পকেটস্থ করল।
সামনে বাস আর ট্যাক্সি সমান ডাকাডাকি করছে–দার্জিলিং-খরসাং–কালিম্পং–
আমি বললুম–দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে টেনিদা? একটা বাসে-টাসে উঠে পড়া যাক।
–দাঁড়া না ঘোড়ার ডিম। আগে সোরাবজীর রেস্তোরাঁ থেকে ভালো করে রেশন নিয়ে নিই। নইলে পঞ্চাশ মাইল পাহাড়ি রাস্তায় যেতে যেতে পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত হজম হয়ে যাবে। চল, খেয়ে আসা যাক।
খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ঠিক করতে আরও ঘণ্টাখানেক গেল। তারপর বাক্স খুলে গরম কোট-টোট বের করে নিয়ে আমরা রওনা হলুম দার্জিলিঙের পথে।
নীল পাহাড়ের দিকে আমাদের গাড়িখানা ছুটে চলল তীরের বেগে। চমৎকার রাস্তা। একটু এগিয়ে চায়ের বাগান, তারপর দুধারে শুরু হয়ে গেল শালের বন। ঠাণ্ডা ছায়া আর হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল যেন। আমি বেশ উদাস গান জুড়ে দিলাম আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি—
হাবুল সেন কানে হাত চাপা দিয়ে বললে–ইস, কী একখানা সুরই বাইর করতাছস! গানটার বারোটা তো বাজাইলি!
না হয় গলার সুর-টুর আমার তেমন নেই। তাই বলে হাবুল সেন সেকথা বলবার কে! ও তো গলা দিয়ে একটি সুর বের করতে পারে, সেটা হল গর্দভরাগিণী। আমি চটে বললুম-আহা-হা, তুই তো একেবারে সাক্ষাৎ গন্ধর্ব।
ক্যাবলা বললে–তুমলোগ কাজিয়া মত করো। (ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে থাকত, তাই মধ্যে মধ্যে হিন্দী জবান বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে) আসল কথা হল, প্যালার এই গানটি এখানে গাইবার কোনও রাইট নেই। এই বনের ভেতর ও স্বচ্ছন্দেই মারা যেতে পারে। আমরা বাধা দিলেও মারা যেতে পারে, কিন্তু এখানে কিছুতেই ওর জন্ম হয়নি। যদি তা হত, তা হলে ও গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াত, আমাদের সঙ্গে এই মোটরে কিছুতেই বসে থাকত না।
আমাকে বাঁদর বলছে নাকি? একটু আগেই গাছে গোটাকতককে দেখা গেছে সেইটেই ওর বক্তব্য নয় তো?
আমি কী যেন বলতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল টেনিদা।—এর মানে কী? কী মানে হয় একবিতার?
কবিতা? কিসের কবিতা? আমরা তিনজনে টেনিদার দিকে তাকালুম। একটা নীল রঙের ছোট কাগজ ওর হাতে।
—কোথায় পেলে ওটা?
টেনিদা বললে–ওই চকোলেটর প্যাকেটের ভেতর ভাঁজ করা ছিল।
টেনিদার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে হাবুল সেন পড়ল—
মিথ্যে যাচ্চ দার্জিলিং
সেখানে আছে তির শিং।
যাবে তো যাও নীলপাহাড়ি, সে
থায় নড়ে সবুজ দাড়ি।
সেইখানেতে ঝাউবাংলায়
(লেখা নেইকো বুড়ো আংলায়)
গান ধরেছে হাঁড়িচাঁচায়,
কুণ্ডুমশাই মুণ্ডু নাচায়।
—শীঝুমুরলাল চৌবে চক্রবর্তী
আমরা চারজন কবিতা পড়ে তো একেবারে থ। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে মাথা চুলকে ক্যাবলা বলল—এর অর্থ কী?
দুধারের ছায়াঘেরা শালবনের ভেতর থেকে এর কোনও অর্থ খুজে পাওয়া গেল না।
০২. সেই সবুজ দাড়ি
তারপর দার্জিলিঙে গিয়ে আমরা তো সব ভুলে গিয়েছি। আর দার্জিলিঙে গেলে কারই বা অন্য কথা মনে থাকে বলে! তখন আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝলমল করে, ম্যাল দিয়ে টগবগিয়ে ঘোড়া ছোটে, জলাপাহাড়ে উঠছি তো উঠছিই। সিঞ্চলের বুনো পথে কত রকম পাখি ডাকছে। কলকাতার গরমে মানুষ যখন আইঢাই করছে আর মনের দুঃখে আইসক্রিম খাচ্ছে, তখন গরম কোট গায়ে দিয়েও আমরা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি।