ফেলে দিলুম, তারপরেই ভয়ে বন্ধ করলুম চোখ দুটো। পুঁটলিটা নীচে পড়ল, কিন্তু কোনও অঘটন ঘটল না, কোনও বিস্ফোরণও হল না। তাকিয়ে দেখি, ওরা গুটিগুটি পুঁটলিটার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু গাছে আর থাকা যায় না কাঠপিঁপড়েরা আমার ছাল-চামড়া তুলে নেবার প্ল্যান করেছে বলে মনে হল। আমি প্রাণপণে নামতে আরম্ভ করলুম।
আর নেমে দেখি—
ওরা সব থ হয়ে পুঁটলিটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। ওটা খোলা হয়েছে আর ওর ভেতরে কাঁচাকলা! স্রেফ চারটে কাঁচকলা! সাধুভাষায় যাকে তরুণ কদলী বলা যায়।
টেনিদা নাকটাকে ছানার জিলিপির মতো করে বললে–এর মানে কী? এত কাণ্ড করে চারটে কাঁচকলা!
ক্যাবলা মোটা গলায় বললে, ঠিক চারটে। আমরাও চারজন। মাথাপিছু একটা করে।
হাবুল বললে–তা হলে আমাগো–
আর বলতে পারল না, তক্ষুনি ছটাং-ছটাং–
অদৃশ্য শত্রুর অস্ত্র ছুটে এল আমাদের দিকে। একটা পড়ল টেনিদার নাকে, আর একটা হাবুলের মাথায়। টেনিদা লাফিয়ে উঠলো-ইঁ-ইঁ-ইঁ—
হাবুল হাউ হাউ করে বললে–খাইছে—খাইছে–।
তা খাইছে খাইছে ও বলতেই পারে! দুটো সাংঘাতিক অস্ত্র—মানে পচা ডিম। পড়েই ভেঙেছে। টেনিদার মুখ আর হাবুলের মাথা বেয়ে নামছে বিকট দুর্গন্ধের স্রোত!
আমি কী বলতে যাচ্ছিলুম, সঙ্গে সঙ্গে আর একটা পচা ডিম এসে আমার পিঠেও পড়ল। আর একটা ক্যাবলার কান ঘেঁষে বোঁ করে বেরিয়ে গেল—একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট।
১১. ক্যাচ-কট-কট
চারটে কাঁচকলার ধাক্কা যদি বা সামলানো গিয়েছিল, পচা ডিম আমাদের একেবারে বিধ্বস্ত করে দিলে। বিশেষ যে লেগেছিল তা নয় কিন্তু তার কী খোশবু। সে-গন্ধে আমি তো তুচ্ছ স্বয়ং গন্ধরাজ ছুঁচোর পর্যন্ত দাঁতকপাটি লেগে যাবে।
হাবুল বললে–ইস, দফাখান সাইরা দিছে একেবারে। অখনি গিয়া সাবান মাইখ্যা চান করন লাগব।
আমি মিষ্টি গলায় পিনপিন করে বললুম—আমার এমন ভালো কোটটাকে—
কথাটা শেষ হল না। তার আগেই ক্যাবলা বললে–টেনিদা, উয়ো দেখ্খো।
ক্যাবলা অনেকদিন পশ্চিমে ছিল, চটে গেলে কিংবা খুশি হলে কিংবা উত্তেজিত হলে ওর গলা দিয়ে হিন্দী বেরুতে থাকে। পচা ডিমের গন্ধে টেনিদা তখন তিড়িং-মিড়িং করে লাফাচ্ছিল, দাঁত খিঁচিয়ে বললে– কী আবার দেখব র্যা? তোর কুবুদ্ধিতে পড়ে সেই জোচ্চোর কাগামাছিটার হাতে–
ক্যাবলা বললে–আরে জী, জেরা আঁখসে দেখোনা উধার–উয়ো পেড় কি পিছে।
টেনিদা থমকে গেল।
—আরে তাই তো! ওই গাছটার পেছনে কেউ লুকিয়ে আছে মনে হয়। ওই লোকটাই তাহলে ডিম ছুড়ে মেরেছে, নির্ঘাত! পীরের সঙ্গে মামদোবাজি–বটে।
টেনিদা এমনিতে বেশ আছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, আমাদের পকেটে হাত বুলিয়ে দিব্যি আলুকাবলি থেকে চপ-কাটলেট পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, কিছু বলতে গেলেই চাঁটি কিংবা গাঁট্টা বাগিয়ে তেড়ে আসছে, কিন্তু কাজের সময় একেবারে অন্য চেহারা—যাকে বলে সিংহ। তখনই আমাদের আসল লিডার। আমাদের পাড়ায় ওদিকে গত বছর বস্তিতে আগুন ধরে গেল, ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছবার আগেই একটা বাচ্চাকে পাঁজাকোলা করে বেরিয়ে এল তিন লাফে! সাধে কি টেনিদাকে এত ভালবাসি আমরা।
গাছের আড়ালে শত্রুকে দেখতে পেয়েই টেনিদা গায়ের কোটটাকে ছুঁড়ে ফেলল। বললে–হা-রে-রে-রে! আজ এক চড়ে কাগামাছির মুণ্ডু যদি কাটমুণ্ডুতে পৌঁছে না দিই তবে আমি টেনি মুখুজ্যেই নই।
বলেই ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস শব্দে এক রাম চিৎকার। তারপরেই এক লাফে ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে তীরের মতো গাছটার দিকে ছুটে গেল; আমরা হতভম্বের মত চেয়ে রইলুম, ইয়াক ইয়াক পর্যন্ত বলতে পারলুম না।
টেনিদাকে তীরের মতো ছুটতে দেখেই লোকটা ভোঁ দৌড়। ঝোপজঙ্গলের মধ্যে ভালো দেখা যাচ্ছিল না, তবু যেন মনে হল, লোকটা যেন আমাদের অচেনা নয়, কোথাও ওকে দেখেছি!
বনের মধ্যে দিয়ে ছুটল লোকটা। টেনিদা তার পেছনে। এক মিনিট পরেই আর কিছু দেখতে পেলুম না, শুধু দৌড়ানোর আওয়াজ আসতে লাগল। তারপরেই কে যেন ধপাস করে পড়ল, খানিকটা ঝটাপটির আওয়াজ আর টেনিদার চিৎকার কানে এল : হাবুল-প্যালা-ক্যাবলা, ক্যাচ- কট-কট! কুইক–কুইক!
ক্যাচ কট কট। তার মানে কাউকে ধরে ফেলেছে!
ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক-ইয়াক। আমরা তিনজনে বোঁ-বোঁ করে ছুটলুম সেদিকে। পাহাড়ি উচু নিচু রাস্তায় ছুটতে গিয়ে নুড়িতে পা পিছলে যায়, ডান হাতে বিছুটির মতো কী লেগে জ্বালাও করতে লাগল, কিন্তু আর কি কোনওদিকে তাকাবার সময় আছে এখন! এক মিনিটের মধ্যেই টেনিদার কাছে পৌঁছে গেলুম আমরা।
দেখি, টেনিদা বসে আছে মাটিতে। তার এক হাতে একটা মেটে রঙের ধুসো মাফলার, আর এক হাতে দুটো চকোলেট। সামনে কতকগুলো কাগজপত্র ছড়ানো।
আমরা কিছু বলবার আগেই টেনিদা করুশ গলায় বললে– ধরেছিলুম লোকটাকে, একদম জাপটে। কিন্তু দেখছিস তো, পাথর কী রকম পেছল, স্লিপ করে পড়ে গেলুম। লোকটাও খানিক দূরে কুমড়োর মতো গড়িয়ে উঠে ছুট লাগাল। এদিকে দেখি, একটা পা একটু মচকে গেছে—আর তাড়া করতে পারলুম না।
ক্যাবলা বললে–কিন্তু এগুলো কী?
—সেই হতচ্ছাড়া কাগামাছি না বগাহাঁচির পকেট থেকে পড়েছে। আর ধুসো মাফলারটা আমি কেড়ে নিয়েছি। বলেই একটা চকোলেটের মোড়ক খুলে তার এক টুকরো ভেঙে নির্বিকারভাবে মুখে পুরে দিলে।
ক্যাবলা বললে–দাঁড়াও—দাঁড়াও, চকোলেট খেয়ো একটু পরে। এই মাফলারটাকে চিনতে পারছ?
—চিনতে বয়ে গেছে আমার। চকোলেট চিবোতে চিবোতে টেনিদা বললে–যেমন বিচ্ছিরি দেখতে, তেমনি তেল-চিটচিটে, বুঝলি, কাগামাছিটা বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হলে কী হয়, লোকটার কোনও টেস্ট নেই, নইলে অমন একটা বোগাস মাফলার গলায় জড়িয়ে রাখে!