হাবুল বললে–না—পাই নাই। খুঁইজ্যা দেখতাছি। যদি চকোলেটখানাও এইখানে পইড়া থাকে, তাহলে জুত কইরা খাওন যাইব।
–জুত করে আর খেতে হবে না! চলে আয়!–কড়া গলায় ডাকল ক্যাবলা। ব্যা
জার হয়ে হাবুল চলে এল। আর এর মধ্যেই আর-একটা আবিষ্কার করল টেনিদা।
মোড়কটার পেছন দিকে শাদা কাগজের ওপর পেনসিল দিয়ে কী সব লেখা।
—এ আবার কী রে ক্যাবলা?
ক্যাবলা কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগল। এবারেও একটা ছড়া—
সাঁতরামশাই গুম
টাক ড়ুমাড়ুম ড়ুম।
বৃক্ষে ও কী লম্ব
বলছে শ্ৰীকদম্ব!
সেই কদম্ব পাকড়াশি! সেই ধুসো মাফলার জড়ানো, সেই মিচকে-হাসি ফিচকে লোকটা! লেখা পড়ে আমরাও গুম হয়ে রইলুম। তারপর টেনিদা বললে– ক্যাবলা!
ক্যাবলা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললে–হুঁ!
–কী বুঝছিস?
—এই জঙ্গলের মধ্যেই তা হলে কোথাও ওরা আছে।
—কিন্তু কোথায় আছে? আমি বললুম-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একেবারে সিকিম-ভূটান পার হয়ে যাব নাকি?
ক্যাবলা আরও গম্ভীর হয়ে বললে–দরকার হলে তাও যেতে হবে।
—খাইছে! হাবুলের আর্তনাদ শোনা গেল।
ক্যাবলা তাতে কান দিল না। ছড়াটা আর একবার নিজে নিজেই আউড়ে নিয়ে বললে–সাঁতরামশাই গুম হয়েছেন এটা তো পরিষ্কার দেখাই যাচ্ছে।
—আর সেইজন্য আনন্দে কাগামাছি আর কদম্ব বলছে টাকড়ুমাড়ুম। আমি ব্যাখ্যা করে দিলুম।
হাবুল বললে– কদম্ব সেই কথাই কইতে আছে।
ক্যাবলা ভুরু কোঁচকাল। শার্টের পকেট থেকে একটা চুয়িংগাম মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললে–এ-সব ঠিক আছে। কিন্তু বৃক্ষে ও কী লম্ব—এর মানে কী?—গাছে কী ঝুলছে?
—গাছে কী ঝুলব? পাকা কাঁটাল ঝুলতে আছে বোধ হয়।
শুনেই টেনিদা ভীষণ খুশি হয়ে উঠল!
—পাকা কাঁটাল ঝুলছে? তাই নাকি? কোথায় ঝুলছে রে?
–তুমলোগ কেতনা বেফায়দা বাত কর রহে হো?–ক্যাবলা চেঁচিয়ে উঠল—খাওয়ার কথা শুনলেই তোমাদের কারও আর মাথা ঠিক থাকে না। পাইন বনের ভেতর পাকা কাঁটাল কোত্থেকে ঝুলছে? আর এই সময়? ওর একটা গভীর অর্থ আছে, বলে আমার মনে হয়।
–কী অর্থ শুনি?-কাঁটাল না পেয়ে ব্যাজার হয়ে জিগগেস করল টেনিদা।
—একটু দেখতে হচ্ছে। চলো, এগোনো যাক।
বেশি দূর এগোবার দরকার হল না। এবারে চেঁচিয়ে উঠল হাবুলই।
—ওই—ওইখানেই ঝুলতাছে।
–কী ঝুলছে? কী ঝুলছে?—আমরা আরও জোরে চিৎকার করলুম।
—দেখতে আছ না? ওই গাছটায়?
কী একটা পাহাড়ি গাছ। বেশি উঁচু নয়, কিন্তু অনেক ডালপালা আর তাতে বানর লাঠির মতো লম্বা লম্বা সব ফল রয়েছে। সেই গাছের মগডালে শাদা কাপড়ের একটা পুঁটলি।
আমরা খানিকক্ষণ হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইলুম। তারপর টেনিদা বললে–তা হলে ওটাই সেই বৃক্ষে লম্ব ব্যাপার।
ক্যাবলা বললে–হুঁ।
টেনিদা বললে–তা হলে ওটাকে তো পেড়ে আনতে হয়।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললুম—দরকার কী টেনিদা——যা লম্বা হয়ে আছে তা ওই লম্বমান। থাকুক না! ওটাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজ নেই।
হাবুল বললে–হ, সত্য কইছস। কয়েকটা বোম্বা-টোম্বা লম্ব কইরা রাখছে কি না কেডা কইব? দুড়ুম কইরা ফাইট্যা গিয়া শ্যাষে আমাগো উড়াইয়া দিব।
টেনিদা বললে—হুঁ– তা-ও অসম্ভব নয়।
ক্যাবলা বললে– ভিতুর ডিম সব! ছো ছো, এমনি কাওয়ার্ডের মতো তোমরা কাগামাছির সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাও! যাও—এখুনি সবাই মুখে ঘোমটা টেনে দার্জিলিঙে পালিয়ে যাও!
টেনিদা মধ্যে-মধ্যে বেগতিক দেখলে এক-আধটু ঘাবড়ে যায় বটে, কিন্তু কাওয়ার্ড কথাটা শুনলেই সে সিংহের মতো লাফিয়ে ওঠে। আর আমি পটলডাঙার পালারাম, এককালে যার কচি পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোলই নিত্য বরাদ্দ ছিল, আমার মনটাও সঙ্গে সঙ্গে শিঙিমাছের মতো তড়পে ওঠে।
টেনিদা বললে–কী বললি! কাওয়ার্ড! ঠিক আছে, মরতে হয় তো আমিই মরব! যাচ্ছি গাছে উঠতে। শুনে আমার রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে গেল :
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও মনে হল, বীরের মতো মরবার সুযোগ যদি এসেই থাকে আমিই বা ছাড়ব কেন? এগিয়ে গিয়ে বললুম-তুমি আমাদের লিডার—মানে সেনাপতি। প্রাণ দিতে হলে সৈনিকদেরই দেওয়া উচিত। সেনাপতি মরবে কেন? আমিই গাছে উঠব।
ক্যাবলা বললে–শাবাশ-শাবাশ!
আর টেনিদা আর হাবুল মিলে দারুণ ক্ল্যাপ দিয়ে দিলে একখানা! ক্ল্যাপ পেয়ে ভীষণ উৎসাহ এসে গেল। আমি তড়াক করে গাছে চড়তে গেলুম। কিন্তু একটু উঠেই টের পেলুম, প্রাণ দেওয়াটা শক্ত কাজ নয়—তার চাইতে আরও কঠিন ব্যাপার আছে। মানে কাঠপিঁপড়ে!
টেনিদা বললে–তাতে কী হয়েছে! বীরের মতো উঠে যা! আর নজরুলের মতো ভাবতে থাক : আমি ধূর্জটি–আমি ভীম ভাসমান মাইন।
কামড়ে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিচ্ছে—এখন মাইন-টাইন কারও ভালো লাগে? দাঁত-টাঁত খিঁচিয়ে মুখটাকে ঠিক ডিমের হালুয়ার মতো করে আমি গাছের ডগায় উঠে গেলুম!
সামনেই দেখছি কাপড়ের পুঁটলিটা। একবারের জন্য হাত কাঁপল, বুকের ভেতরটা হাঁকপাঁক করে উঠল। যদি সত্যিই একটা বোমা ফাটে? যদি কিন্তু ভেবে আর লাভ নেই। কবি লিখেছেন—মরতে হয় তো মর গে! আর যেরকম পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে, তাতে বোমার ঘায়ে মরাই ঢের বেশি সুখের বলে মনে হল এখন।
দিলুম হাত। ভেতরে কতগুলো কী সব রয়েছে। ফাটল না।
টেনিদা বললে,—টেনে নামা। তারপর নীচে ফেলে দে।
আমি দেখলুম, পুঁটলিটা আলগা করেই বাঁধা আছে, খুলতে সময় লাগবে না, নীচে ওদের ডেকে বললুম—আমি ফেলছি, তোমরা সবাই সরে যাও। যদি ফাটে-টাটে—