একখানা চিঠিই বটে। আমরা একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে দেখলুম, চিঠিতে লেখা আছে : প্রিয় চার বন্ধু!
কাগামাছি দলবল নিয়ে ঘেরাও করেছে—দুমিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে। আমি জানি, এক্ষুনি তারা লোপাট করবে আমাকে। তাই ঝটপট লিখে ফেলছি চিঠিল। আমাকে গায়েব করে ফরমুলাটা জেনে নেবে। তোমরা আমাকে খুঁজতে চেষ্টা কোরো। কিন্তু সাবধান—পুলিশে খবর দিয়ো না। তা হলে তক্ষুনি আমায় খুন–
আর লেখা নেই। কিন্তু চিঠিটা যে সাতকড়িরই লেখা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বেশ বোঝা যাচ্ছে, এটুকু লেখবার পরেই সদলবলে কাগামাছি এসে ওঁকে খপ করে ধরে ফেলেছে।
রহস্য নিদারুণ গভীর! এবং ব্যাপার অতি সাংঘাতিক!
আমরা চারজনেই দারুণ ঘাবড়ে গিয়ে মাথা চুলকোতে লাগলুম। এখন কী করা যায়?
একটু পরে টেনিদা বললে–দা-দার্জিলিঙেই চলে যাব নাকি রে?
হাবুল বললে–হ, সেইডা মন্দ কথা না। বজ্ৰবাহাদুর গাড়ি নিয়া আসলেই–
ক্যাবলা চটে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল—তোমাদের লজ্জা করে না? বিপদে পড়ে ভদ্রলোক ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তাঁকে ডাকাতের হাতে ফেলে পালাবে? পটলডাঙার ছেলেরা এত কাপুরুষ? এর পরে কলকাতায় ফিরে মুখ দেখাবে কী করে?
হাবুল সেনের একটা গুণ আছে সব সময়েই সকলের সঙ্গে সে চমৎকার একমত হয়ে যেতে পারে। সে বললে–হ সত্য কইছ। মুখ দ্যাখান যাইব না।
আমি বললুম–কিন্তু সাঁতরামশাইকে কোথায় পাওয়া যাবে? হয়তো এতক্ষণে তাঁকে কোনও গুপ্তগৃহে–
–শাট আপ—গুপ্তগৃহ! রাগের মাথায় ক্যাবলার মুখ দিয়ে হিন্দীতে বেরুতে লাগল—কেয়া, তুমলোগ মজাক কর রহে হে? বে-কোয়াশ বাত ছোড়। গুপ্তগৃহ অত সহজে মেলে নাও শুধু ডিটেকটিভ বইতেই লেখা থাকে। চলোবাড়ির পেছনে পাইনের বনটা আগে একটু খুঁজে দেখি! তারপর যা হয় প্ল্যান করা যাবে!
টেনিদা মাথা চুলকে বললে–এক্ষুনি?
–এক্ষুনি।
টেনিদার খাঁড়ার মতো নাকের ডগাটা কেমন যেন বেঁটে হয়ে গেল—মানে একটু চা-টা না খেয়ে বেরুলে কী বলে ঠিক গায়ের জোর পাওয়া যাবে না। খিদেও তো পেয়েছে–তাই–
ক্যাবলা বললে–এই কি তোমার খাবার সময়? শেম—শেম!
শেম—শেম শুনেই আমাদের লিডার সঙ্গে সঙ্গে বুক টান করে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরের একটা খুঁটি ধরে বার তিনেক বৈঠক দিয়ে টেনিদা বললে–অলরাইট! চল—এই মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়া যাক।
কিন্তু কাঞ্ছা অতি সুবোধ বালক। সাতকড়ি লোপাট হয়ে গেছেন বটে, কিন্তু কাঞ্ছা নিজের ডিউটি ভুলে যায়নি। সে বললে–ব্রেকফাস্ট তৈরিই আছে বাবু। খেয়েই বেরোন।
ক্যাবলার দিকে আমরা ভয়েভয়ে তাকালুম। ক্যাবলা বললে––বেশ, তা হলে খেয়েই বেরুনো যাক। কিন্তু মাইন্ড ইট-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাদের বেরুতে হবে। আর এই প্যালাটা যে আধ ঘণ্টা ধরে বসে টোস্ট চিবুবে সেটা কিছুতেই চলবে না।
–বা-রে, যত দোষ আমার ঘাড়েই! আমার রাগ হয়ে গেল। বললুম—আমিই বুঝি আধ ঘণ্টা ধরে টোস্ট চিবুই? আর তুই যে কালকে এক ঘণ্টা ধরে মুরগির ঠ্যাং কামড়াচ্ছিলি, তার বেলায়?
টেনিদা কড়াং করে আমার কানে জোর একটা চিমটি দিয়ে বললে–ই চোপ-বিপদের সময় নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে নেই।
আমি চেঁচিয়ে বললুম-খালি আমাকেই মারলে? আর ক্যাবলা যে—
—ঠিক। ও-ও বাদ যাবে না বলেই টেনিদা ক্যাবলাকে লক্ষ্য করে একটা রাম চাঁটি হাঁকড়াল। ক্যাবলা সুট করে সরে গেল, আর চঁচিটা গিয়ে পড়ল হাবুলের মাথায়।
—খাইছে খাইছে! বলে চেঁচিয়ে উঠল হাবুল। একেবারে ষাঁড়ের মতো গলায়।
১০. শত্রুর ভীষণ আক্রমণ
খেয়েদেয়ে আমরা বনের মধ্যে ঢুকে পড়লুম।
ঝাউবাংলোর ঠিক পেছনেই জঙ্গলটা! পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে কত দূর পর্যন্ত চলে গেছে কে জানে! সারি সারি পাইনের গাছ, এখানে-ওখানে টাইগার ফার্নের ঝোপ, বড় ধুতরোর মতো শানাই ফুল, পাহাড়ি উঁই-চাঁপা। শাদায়কালোয় মেশানো সোয়ালোর ঝাঁক মধ্যে-মধ্যে আশপাশ দিয়ে উড়ে যেতে লাগল তীর বেগে, কাকের মতো কালো কী পাখি লাফাতে লাফাতে বনের ভেতর অদৃশ্য হল আর লতা-পাতা, সোঁদা মাটি, ভিজে পাথরের ঠাণ্ডা গন্ধ—সব মিলিয়ে ভীষণ ভালো লাগল জঙ্গলটাকে।
আমি ভাবছিলুম এই রকম মিষ্টি পাহাড় আর ঠাণ্ডা বনের ভেতর সন্নিসি-টন্নিসি হয়ে থাকতে আমিও রাজি আছি, যদি দুবেলা বেশ ভালোমতন খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত থাকে। সত্যি বলতে কী, আমার সকালবেলাটাকে ভীষণ ভালো লাগছিল, এমন কি সবুজদাড়ি, সাতকড়ি সাঁতরা, সেই হতচ্ছাড়া কাগামাছি, সেই মিচকেপটাশ কদম্ব পাকড়াশি—সব মুছে। গিয়েছিল মন থেকে। বেশ বুঝতে পারছিলুম, এই বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ান বলেই সাতকড়ির মগজে কবিতা বিজ বিজ করতে থাকে :
ওগো পাইন,
ঝিলমিল করছে জ্যোৎস্না
দেখাচ্ছে কী ফাইন!
আমিও প্রায় কবি-কবি হয়ে যাচ্ছি, এমন সময় টেনিদা বললে–দুৎ, এসবের কোনও মানেই হয় না। কোথায় খুঁজে বেড়াবে বল দিকি বনের মধ্যে? আর তা ছাড়া সাতকড়িবাবুকে নিয়ে জঙ্গলের দিকেই তারা গেছে তারও তো প্রমাণ নেই।
আমি বললুম-ঠিক। সামনে অত বড় রাস্তা থাকতে খামকা জঙ্গলেই বা ঢুকবে কেন?
ক্যাবলা বললে–প্রমাণ চাও? ওই দ্যাখো!
আরে তাই তো! একটা ঝোপের মাথায় রঙচঙে কী আটকে আছে ওটা? এক লাফে এগিয়ে গিয়ে সেটাকে পাকড়াও করল হাবুল
এই জিনিসটা আর কিছুই নয়। চকোলেটের মোড়ক! তা হলে নিশ্চয়—
আমি বললুম–কদম্ব পাকড়াশি!
হাবুল ঝোপের মধ্যে কী খুঁজছিল।
ক্যাবলা বললে–আর কিছু পেলি নাকি রে?