টেনিদা বললে–আমরাও পাহারা দেব!
-না-না, সে কী হয়। হাজার হোক তোমরা আমার অতিথি। শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো। দরকার হলে তোমাদের আমি ডাকব এখন।
আমরা যখন শুতে গেলাম, তখন ঝাউ বাংলোর হলঘরের ঘড়িটায় টং করে একটা বাজল।
শোবার আগে দুটো কাজ করল ক্যাবলা। প্রথমে দড়ি টেনে টেনে সব কটা স্কাইলাইট ভালো করে বন্ধ করল, তারপর ড্রেসিং টেবিলটা টেনে এনে পাশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড় করালে যাতে ওখান থেকে কাগামাছি আবার আমাদের দেওয়ালে প্রজেক্টারের আলো ফেলতে না পারে।
তারপর কাগামাছির কথা ভাবতে-ভাবতে আমাদের ঘুম এল, আর সেই ঘুম একটানা চলল সকাল পর্যন্ত। কিন্তু তখন আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি—পরের দিন কী নিদারুণ বিভীষিকা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
০৯. সাতকড়ি গায়েব
ঘুমব কী ছাই! সকলকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে হল কাঞ্ছর হাঁউমাউ চিৎকারে।
–কী হল কাঞ্ছা–ব্যাপার কী?
কাঞ্ছা বললে–বাবু গায়েব।
–গায়েব?
কাঞ্ছা জবাব দিল–জু!
—কোথায় গায়েব? কেমন করে গায়েব?
কাঞ্জা হাঁউমাউ করে অনেক কথাই বলে গেল নেপালী ভাষায়। তোমরা তো আর সবাই নেপালী বুঝবে না, সন্দেশের সম্পাদকমশাইরাও সে কান্না-ভেজানো ভাষা কতটা বুঝবেন তাতে আমার সন্দেহ আছে। তাই সকলের সুবিধের জন্যে কাঞ্ছার কথাগুলো মোটামুটি শাদা বাংলায় লিখে দিচ্ছি—
কাঞ্ছার বক্তব্য হচ্ছে—
রোজ ভোর পাঁচটায় নাকি সাতকড়ি সাঁতরা এককাপ চা খেতেন। কাঞ্ছা বললে–ব্যাড-টি। আর শৌখিন লোক সবুজদাড়ি সাঁতরামশাই খারাপ চা খেতেন ভাবতেই আমরা বিচ্ছিরি লাগল। ক্যাবলা আমার কানে কানে বললে––বোধ হয় বেড-টি মিন করেছে। যাই হোক, ভোরবেলা কাঞ্ছা চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই একেবারে থ। বাংলা ডিটেকটিভ বইতে লেখা থাকে—হুবহু ঠিক তাই ঘটেছে। অর্থাৎ ঘরটি একেবারে তছনছ বালিশ কম্বল সব মেঝেয় পড়ে আছে, এক কোণে একটা টিপয় কাত হয়ে রয়েছে, কার একটা ভাঙা হুঁকো রয়েছে সাতকড়ির বিছানার ওপর, দরজার বাইরে একগাছা মুড়ো ঝাঁটা, সিঁড়িতে দেখা যাচ্ছে কুকুরে-চিবুনো একপাটি চপ্পল। মানে অনেক কিছুই আছে—কেবল নেই সাতকড়ি সাঁতরা। তিনি স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছেন।
টেনিদা বললে–বোধহয় বেড়াতে বেরিয়েছেন।
কাঞ্ছা জানালে, সেটা অসম্ভব। কারণ ভোর পাঁচটায় ব্যাড-টি না পেলে, পাঁচটা বেজে সাত মিনিটের সময় সাতকড়ি চিৎকার করে কাঞ্ছাকে ডাকেন আর গ্যাড-ম্যাড করে ইংরেজীতে গাল দিতে থাকেন। সুতরাং চা না খেয়ে ঘর থেকে বেরুবেন এমন বান্দাই তিনি নন। তা ছাড়া নিজের বালিশ-বিছানা নিয়ে এর আগে তাঁকে কোনওদিন কুস্তি লড়তেও দেখা যায়নি। আরও বড় কথা, ভাঙা হুঁকো, মুড়ো ঝাঁটা আর কুকুরে-চিবনো চপ্পলই বা এল কোত্থেকে? তবু দেড় ঘণ্টা-দু ঘণ্টা ধরে কাঞ্ছা সব জায়গায় তাঁকে খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও তাঁর সবুজ দাড়ির ডগাটি পর্যন্ত খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত এসে ডেকে তুলেছে আমাদের।
কিছুক্ষণ আমরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলুম। শেষে টেনিদা বললে–তা হলে একবার দেখে আসা যাক ঘরটা।
হাবুল সেন বললে–দেইখ্যা আর হইব কী! কাগামাছিতে তারে লইয়া গেছে।
ক্যাবলা বললে–তুই একটু চুপ কর তো হাবুল। দেখাই যাক না একবার।
আমরা সাতকড়ি সাঁতরার ঘরে গেলুম। ঠিকই বলেছে কাঞ্ছা। ঘরের ভেতরে একেবারে হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার। সবকিছু ছড়িয়ে-ড়িয়ে একাকার। ভাঙা হুঁকো ছেঁড়া চপ্পল, মুড়ো-ঝাঁটা—সব রেডি।
টেনিদা ভেবে-চিন্তে বললে–ওই ভেঁড়া চপ্পল পায়ে দিয়ে হুঁকো খেতে খেতে কাগামাছি এসেছিল!
হাবুল মাথা নেড়ে বললে–হ। আর ওই ঝাঁটাটা দিয়া সাঁতরা মশাইরে রাম-পিটানি দিছে।
তখন আমার মগজে দারুণ একটা বুদ্ধি তড়াং করে নেচে উঠল। আমি বললুম-ভাঙা হুঁকোতে তামাক খাবে কী করে? ওর একটা গভীর অর্থ আছে। জাপানীরা হুঁকো কবিতা লেখে কিনা, তাই কাগামাছি কোটা রেখে জানিয়ে গেছে যে সে জাপানী।
শুনে ক্যাবলা ঠিক ডিমভাজার মতো বিচ্ছিরি মুখ করে আমাকে ভেংচে উঠল-থাম থাম, তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না। হাইকু কবিতা হুঁকো হবে কোন্ দুঃখে? আর কার এমন দায় পড়েছে যে সাত বছরের পুরনো কুকুরের-খাওয়া চটি পায়ে দেবে? পায়ে কি দেওয়াই যায় ওটা? তা ছাড়া কে কবে শুনেছে যে ডাকাত মুড়োঝাঁটা নিয়ে আসে? সে তো পিস্তল-টিস্তল নিয়ে আসবে।
—হয়তো কাগামাছির পিস্তল-টিস্তল নেই, সে গরিব মানুষ। আর ওটা যে সাধারণ একটা মুড়ো খ্যাংরা তাই বা কে বললে–? হয়তো ওর প্রত্যেকটা কাঠিতে সাংঘাতিক বিষ রয়েছে, হয়তো ওর মধ্যে ডিনামাইট ফিট করা আছে
ক্যাবলার ডিমভাজার মতো মুখটা এবার আলুকাবলির মতো হয়ে গেল-হয়তো ওর মধ্যে একটা অ্যাঁটম বম আছে, দুটো স্পুটনিক আছে, বারোটা নেংটি ইঁদুর আছে? যত সব রদ্দিমাকা ডিটেকটিভ বই পড়ে তোদের মাথাই খারাপ হয়ে গেছে দেখছি। বলে, আমরা হাঁই-হাই করে ওঠবার আগেই সে মুড়োঝাঁটায় জোর লাথি মারল একটা। বোমা ফাটল না, দাড়ম-দুড়ম কোনও আওয়াজ হল না, ক্যাবলা মারা পড়ল না, কেবল ঝাঁটাটা সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে সোজা বাগানে গিয়ে নামল।
ঠিক তখন ক্যাবলা চেঁচিয়ে উঠল—আরে এইটা কী?
হুঁকোর মাথায় যেখানটায় কলকে থাকে, সেখানে একটা কাগজের মতো কী যেন পাকিয়ে গোল করে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। হাবুল হুঁকোটা তুলে আনতেই টেনিদা ছোঁ মেরে কাগজটা তুলে নিলে।
ডিটেকটিভ বইতে যেমন লেখা থাকে, অবিকল সেই ব্যাপার।