টেনিদা বললে–ঘ্যাঁচা-ঘ্যাঁচা করে কানের কাছে বিচ্ছিরিভাবে হাঁড়িচাঁচা ডাকছিল। এককুঁজো জল তার মাথায় ঢেলে ক্যাবলা তাকে তাড়িয়েছে।
হাবুল বললে–আর চালের থনে অ্যাঁকটা কাটা মুণ্ডু বত্রিশটা দাঁত বাইর কইরা তুরুকরুক লাফাইতে আছিল।
টেনিদা কষে একটা গাঁট্টা বাগাল। দাঁতে দাঁত ঘষে বললে– ব্যাটা নির্ঘাত মেফিস্টোফিলিস। একবার সামনে পেলে এমন দুটো ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেরে দেব যে ইয়াক-ইয়াক হয়ে যাবে।
সাতকড়ি বললে–দাঁড়াও-দাঁড়াও, ব্যাপারটা বুঝে দেখি। তার আগে তোমাদের একটু ভুল শুধরে দিই। মেফিস্টোফিলিস হল শয়তান। পুরুষ-ফরাসী ভাষায় মাসকুল্যাঁ! আর মাসকুল্যাঁ হলে বলা উচিত ল্য গ্ৰাঁ। অর্থাৎ কিনা মস্ত বড়। আর ডি–অর্থাৎ দ্য টা ওখানে–
টেনিদা বললে–থামুন-থামুন। আমরা মরছি নিজের জ্বালায়, আর আপনি এই মাঝরাত্তিরে ফরাসী শোনাতে এসেছেন। আচ্ছা নোক তো!
—আচ্ছা, থাক-থাক। এখন খুলে বলো।
আমি বললুম—আপনি হাঁড়িচাঁচার ডাক শোনেননি?
–হাঁড়িচাঁচার ডাক? না তো!সাতকড়ি যেন গাছ থেকে পড়লেন।
হাবুল বললেন কী মশায়? আপনে কুম্ভকর্ণ নাকি! আমাগো কান ফাইটা যাইতাছিল আর আপনে শুনতেই পান নাই?
ক্যাবলা বললে–আঃ। তোরা একটু থাম তো বাপু। এমনভাবে সবাই মিলে বকবক করলে কোনও কাজ হয়? আমি বলছি শুনুন!
টেনিদা বললে– রাইট। অর্ডার— অর্ডার।
ক্যাবলা সব বিশদ বিবরণ শুনিয়ে দিলে সাতকড়িবাবুকে। সাতকড়ি কখনও হাঁ করলেন, কখনও চোখ গোল করলেন, কখনও বললেন, মাই ঘঃ—! শেষ পর্যন্ত শুনে একটা হুতোম প্যাঁচার মতো থ হয়ে রইলেন।
টেনিদা বললে–তা হলে—
-তা হলে সেই কাগামাছি! এবার ঘোর বেগে আমাকে আক্রমণ করেছে দেখছি। না, ফরমুলাটা আর বাঁচানো যাবে না মনে হচ্ছে। আমার এতদিনের সাধনা—এমন যুগান্তকারী আবিষ্কার–সব গেল–
আমি বললুম—এত ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে যদি পুলিশে খবর দেন–
—পুলিশ।–সাতকড়ি সাঁতরা কিছুক্ষণ এমন বিচ্ছিরি মুখ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন যে, মনে হল এর চাইতে অদ্ভুত কথা জীবনে কোনওদিন তিনি শোনেননি।
ক্যাবলা বললে–আচ্ছা সাঁতরামশাই, আমাদের পাশের ঘরে কী আছে?
সাতকড়ি বললে–ওটা? ওটা স্ট্যাকরুম। মানে বাড়ির বাড়তি আর ভাঙাচুররা জিনিসপত্র জড়ো করে রাখা হয়েছে ওতে।
—ওর দরজায় চৌকো ফুটোটা এল কী করে? মানে যা দিয়ে এ-ঘরের দেওয়ালে প্রজেকটার দিয়ে ছবি ফেলা যায়?
—চৌকো ফুটো? সাতকড়ি আকাশ থেকে পড়লেনফুটো আবার কে করবে? ফুটোফাটার কথা আবার কেন? কোনও ফুটোর খবর তো আমি জানিনে।
–তা হলে জেনে নিন। ওই দেখুন।
সাতকড়ি উঠে দেখলেন আর দেখেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
–সর্বনাশ! কাগামাছি দেখছি আমার ঘরে আড্ডা গেড়েছে। এবার আমি গেলুম।-সবুজ দাড়ি মুঠোয় চেপে ধরে তিনি হায় হায় করতে লাগলেন—একেবারে মারা গেলুম দেখছি।
ক্যাবলা বললে–মারা একটু পরে যাবেন। তার আগে ওই ঘরটা খুলবেন চলুন।
—ঘর? মানে ও-ঘরটা? ও খোলা যায় না!
—কেন খোলা যায় না?
সাতকড়ি বুঝিয়ে বললেন—মানে আসবার সময় ও-ঘরের চাবি কলকাতায় ফেলে এসেছি কিনা। আর দুটো পেল্লায় তালা ও-ঘরে লাগানো আছে।
—সে-তালা ভাঙতে হবে!
সাতকড়ি হেসে বললেন—তা হলে দার্জিলিং থেকে কামার আনতে হয়। এমনিতে ও ভাঙবার বস্তূ নয়।
টেনিদা বললে–চলুন, দেখা যাক।
সবাই বেরুলুম। সারা বাড়িতে আলো জ্বলছে তখন। সাতকড়িই জ্বেলে দিয়েছেন নিশ্চয়। পাশের ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল ঠিকই বলেছেন ভদ্রলোক। আধ হাত করে লম্বা দুটো তালা ঝুলছে। কামারেরও শানাবে বলে মনে হল না—খুব সম্ভব কামান দাগাতে হবে।
টেনিদা বললে– কাল সকালে দেখতে হবে ভালো করে।
ক্যাবলা বললে–এবার চলুন, বাইরে বেরুনো যাক।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললুম—আবার বাইরে কেন? কোথায় কাগামাছির লোক ঘাপটি মেরে বসে আছে। তার ওপর এই হাড়-কাঁপানো শীত–বরং কালকে–
ক্যাবলা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললে–তবে তুই একলা ঘরে শুয়ে থাক। আমরা দেখে আসি।
সর্বনাশ, বলে কী! একলা ঘরে থাকব! আর কায়দা পেয়ে ওপর থেকে কাটা মুণ্ডুটা ঝাঁ করে আমাকে তেড়ে আসুক! কামড়াবারও দরকার হবে না—আর-একবার দন্ত-বিকাশ করলেই আমি গেছি।
দাড়িটা চুলকে নিয়ে বললুম–না-না, চলো, আমি তোমাদের সঙ্গেই যাচ্ছি। মানে, তোমাদেরও তো একটু সাহস দেওয়া দরকার!
বাইরে ঠাণ্ডা কালো রাত। পাইনের বন কাঁপিয়ে হু হু করে বাতাস দিচ্ছে–কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। দূরের কালো কালো পাহাড়ের মাথায় মোটা ভুটিয়া কম্বলের মতো পুরু পুরু মেঘ জমেছে, লাল বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে তার ভেতরে। সব মিলিয়ে যেন বুকের মধ্যে কাঁপুনি ধরে গেল আমার। এমন রাতে কোথায় ভরপেট খেয়ে লেপ কম্বলের তলায় আরামসে ঘুম লাগাব, তার বদলে হতচ্ছাড়া কাগামাছির পাল্লায় পড়ে-উফ!
সাতকড়ি সঙ্গে টর্চ এনেছিলেন। সেই আলোয় আমরা দেখলুম, ঠিক আমাদের জানালার নীচে মাটিতে খানিকটা জল রয়েছে তখনও, আর তার ভেতর কার জুতোপরা পায়ের দাগ।
ক্যাবলা বললে– হাঁড়িচাঁচা। মাথায় জল পড়তে কেটে পড়েছে।
পাশেই ঘাস। কাজেই জুতোপরা হাঁড়িচাঁচা কোনদিকে যে পালিয়েছে বোঝা গেল না। আরও খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে আমরা আবার ফিরে এলুম।
সাতকড়ি বললেন—যা হওয়ার হয়েছে এবার তোমরা শুয়ে পড়ো। আজ আর কোনও উৎপাত হয়তো হবে না। যাই হোক আমি রাত জেগে পাহারা দেব এখন।