ক্যবলা বললে, হুঁ, তা হলে শুয়েই পড়া যাক। আবার যদি হাঁড়িচাঁচা বিরক্ত করতে আসে, তা হলে ওপর থেকে এবার চেয়ার ছুঁড়ে মারব।
কম্বল জড়িয়ে আমরা বিছানায় লম্বা হলুম, মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই টেনিদার নাক কুরকুর করে ডাকতে লাগল, হাবুল আর ক্যাবলাও ঘুমিয়ে পড়ল বলে মনে হল। কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। বাইরে রাত ঝমঝম করছে, ঝিঝি ডাকছেজানালার কাচের ভেতর থেকে কালোকালো গাছের মাথা আর আকাশের জ্বলজ্বলে একরাশ তারা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল বেশ ছিলুম দার্জিলিঙে, খামকা কাগামাছির পেছনে এই পাহাড়-জঙ্গলে এসে পড়েছি। কাছাকাছি জন-মানুষ নেই, এখন যদি কাগামাছি ঘরে ঢুকে আমাদের এক-একজনকে মাছির মতোই টপাটপ গিলে ফেলে, তা হলে আমরা ট্যাঁ-ফোঁ করবারও সুযোগ পাব না। তার ওপর এই শীতে এক-জগ ঠাণ্ডা জল গায়ে ঢেলে দেওয়ায় কাগামাছি নিশ্চয় ভয়ঙ্কর চটে রয়েছে। যদিও হাবুল আমার পাশেই শুয়েছে। তবু সাহস পাবার জন্যে ওকে আমি আস্তে আস্তে ধাক্কা দিলুম।
—এই হাবলা, ঘুমুচ্ছিস নাকি?
আর হাবুল তক্ষুনি হাঁউমাউ করে এক রাম-চিকার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
নাকের ডাক বন্ধ করে টেনিদা হাঁক ছাড়ল—কী—কী–হয়েছে?
ক্যাবলা কম্বলসুষ্ঠু নেমে পড়তে গিয়ে কম্বলে জড়িয়ে দড়াম করে আছাড় খেল একটা।
টেনিদা বললে– কী হয়েছে রে হাবুল, চেঁচালি কেন?
–কাগামাছি আমারে তো মারছে।
–কাগামাছি নয়, আমি।–আমি এই কথাটা কেবল বলতে যাচ্ছি, ঠিক তখন—
তখন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল।
বড় আলো দুটো নিবিয়ে একটা নীল বাতি জ্বেলে আমরা শুয়ে পড়েছিলুম। হালকা আলোয় ছায়া-ছায়া ঘরটার ভেতর দেখা গেল এক রোমহর্ষক দৃশ্য।
আমরাই চোখে পড়েছিল প্রথম। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম-ও কী?
ঘরের ঠিক মাঝখানে–শুন্যে কী ঝুলছে ওঠা!
আবছা আলোতেও স্পষ্ট দেখা গেল—ঠিক যেন হাওয়ায় একটা প্রকাণ্ড কাটামুণ্ডু নাচছে। তার বড় বড় দাঁত, দুটো মিটমিটে চোখ—ঠিক যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে সে।
আমরা চারজনেই এক সঙ্গে বিকট চিৎকার ছাড়লুম। তৎক্ষণাৎ ঘরের নীল আলোটাও নিবে গেল, যেন বিশ্রী গলায় হেসে উঠল, আর আমি–
আমার দাঁতকপাটি লাগল নির্ঘাত। আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগেই টের পেলুম, খাটের ওপর থেকে একটা চালকুমড়োর মতো আমি ধপাস করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছি।
০৮. রাতের তদন্ত
খুব সম্ভব দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল। আর রাত দুপুরে মাথার ওপর বেমক্কা একটা কাটা মুণ্ডু এসে যদি নাচতে শুরু করে দেয় তাহলে কারই বা দাঁতকপাটি না লাগে? কিন্তু বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়েও থাকা গেল না, কে যেন পা ধরে এমন এক হ্যাঁচকা টান মারল যে, কম্বল-টম্বল। সুদ্ধ আমি আর এক পাক গড়িয়ে গেলুম।
তখনও চোখ বন্ধ করেই ছিলুম। হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে বললুম কাগামাছি কাগামাছি।
—দুত্তোর কাগামাছি। ওঠ বলছি—কোত্থেকে যেন ক্যাবলাটা চেঁচিয়ে উঠল।
উঠে বসে দেখি কাটা মুণ্ডু-টু কিছু নেই ঘরে আলো জ্বলছে। টেনিদা হাঁ করে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। হাবুল সেন গুটিগুটি বেরিয়ে আসছে একটা খাটের তলা থেকে।
টেনিদা বললে–ভূতের কাণ্ড রে ক্যাবলা! কাগামাছি স্রেফ ভূত ছাড়া কিছু নয়।
হাবুল কাঁপতে কাঁপতে বললে–মুলার মতো দাঁত বাইর কইর্যা খ্যাঁচখ্যাঁচ কইর্যা হাসতে আছিল। ঘাঁক কইর্যা একখান কামড় দিলেই তো কম্ম সারছিল।
ক্যাবলা বললে–হুঁ।
আমি বললুম—হুঁ কী? রাত ভোর হোক, তারপরেই আমি আর এখানে নেই। সোজা দার্জিলিং পালিয়ে যাব।
ক্যাবলা বুললে—পালা, যে-চুলোয় খুশি যা। কিন্তু যাওয়ার আগে একবার ওই স্কাইলাইটটা লক্ষ করে দেখ।
—আবার মুণ্ডু আসছে নাকি?বলেই হাবুল তক্ষুনি খাটের তলায় ঢুকে পড়ল। টেনিদা একটা লাফ মারল আর আমি পত্রপাঠ বিছানায় উঠে কম্বলের তলায় ঢুকে গেলুম।
ক্যাবলা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললে–আরে তুমলোগ বহুত ডরপোক হো। দ্যাখ না তাকিয়ে ও-দিকে। স্কাইলাইটটা খোলা। ওখান দিয়ে দড়ি বেঁধে একটা মুণ্ডু যদি ঝুলিয়ে দেওয়া যায় আর তারপরেই যদি কেউ সুড়ত করে সেটাকে টেনে নেয়—তা হলে কেমন হয়?
টেনিদা জিগগেস করলে—তা হলে তুই বলছিস ওটা—
—হ্যাঁ যদুর মনে হচ্ছে, একটা কাগজের মুখোশ।
হাবুল আবার গুটিগুটি বেরিয়ে এল খাটের নীচের থেকে। আপত্তি করে বললে–না না, মুখোশ না। মুখে মুলার মতন দাঁত আছিল।
–তুই চুপ কর।–ক্যাবলা চেঁচিয়ে উঠলকাওয়ার্ড কোথাকার। শোন, আমি বলছি। যাওয়ার আগে যদি মুলোর মতো দাঁতগুলোকে আঁড়ো করে দিয়ে যেতে না পারি, তা হলে আমার নাম কুশল মিত্তিরই নয়!
—তার আগে ওইটাই আমাগো কচমচাইয়া চাবাইয়া খাইব।
ক্যাবলা গজগজ করে কী বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় দরজা দিয়ে সাতকড়ি সাঁতরা এসে ঢুকলেন।
–ব্যাপার কী হে তোমাদের? রাত সাড়ে বারোটা বাজে—এখনও তোমরা ঘুমোওনি নাকি। আমি হঠাৎ জেগে উঠে দেখি তোমাদের ঘরে আলো জ্বলছে। তাই খবর নিতে এলুম।
টেনিদা চটে বললে–আচ্ছা লোক মশাই আপনি। এতক্ষণে খবর নিতে এলেন। ওদিকে আমরা মারা যাওয়ার জো! বাইরে থেকে দরজা বন্ধ, ভেতরে ভূতের কাণ্ড চলছে, আর আপনি বলছেন ঘুমুইনি কেন।
সাতকড়ি অবাক হয়ে বললেন—কেন, দরজা তো খোলাই ছিল।
–খোলা ছিল। আধঘণ্টা টানাটানি করে আমরা খুলতে পারিনি।
সাতকড়ি ঘাবড়ে গেলেন। একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন কী হয়েছিল বলে দেখি?
আমি বললুম–বিনামুল্যে ফিলিম শো দেখেছি।