—প্রাণতোষিণী মহাপরিনির্বাণ-তন্ত্রের পাতা উল্টেছ কোনওদিন?
টেনিদা আঁতকে উঠে বললেন—আজ্ঞে না। ওল্টাতেও চাই না।
–নেবু চাডনাজার আর পজিট্রনের কম্বিনেশন কী জানো?
—জানি না।
—থিয়োরি অব রিলেটিভিটির সঙ্গে অ্যাঁকোয়া টাইকোটিস যোগ করলে কী হয় বলতে পারো?
হাবুল বললে–খাইছে!
মিটিমিটি হেসে সাতকড়ি বললেন—তা হলে ফরমুলা দেখে তো কিছু বুঝতে পারবে না।
ক্যাবলা মাথা চুলকোতে লাগল। একটু ভেবে-চিন্তে বললে–দেখুন কী বলে, অ্যাঁকোয়া টাইকোটিস মানে তো জোয়ানের আরকতাই নয়? তা জোয়ানের আরকের সঙ্গে থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি–
—ওই তো আমার গবেষণার রহস্য! সাতকড়ি আবার মিটমিট করে হাসলেন—ওটা বুঝলে তো ফরমুলাটা তুমিই আবিষ্কার করতে পারতে!
টেনিদা বললে– নিশ্চয়-নিশ্চয়! ক্যাবলার কথায় কান দেবেন না। সব জিনিসেই ওর সব সময় টিকটিক করা চাই। এই ক্যাবলা ফের যদি তুই ওস্তাদি করতে যাবি, তা হলে এক চড়ে তোর কান—
আমি বললুম–কানপুরে উড়ে যাবে।
সাতকড়ি বললে–আহা থাক, থাক; নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে নেই। যাক বিকেল তো হল, তোমরা এখন চা-টা খেয়ে একটু ঘুরে এসো—কেমন? রাত্তিরে আবার গল্প করা যাবে।
সাতকড়ি উঠে গেলেন।
আমরা বেড়াতে বেরুলুম। বেশ নিরিবিলি জায়গাটি গ্রামে লোকজন অল্প, পাহাড়-জঙ্গল-ফুল আর ঝরনায় ভরা। থেকে-থেকে ফগ ঘনিয়ে আসছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। দূরে সমতলের একটুখানি সবুজ রেখা দেখা যায়, সেখানে একটা রুপোলি নদী চিকচিক করছে। একজন পাহাড়ি বললে–ওটা তিস্তা ভ্যালি।
সত্যি দার্জিলিঙের ভিড় আর হট্টগোলের ভেতর থেকে এসে মন যেন জুড়িয়ে গেল। আর মংপুর পাহাড়টাকে যতই দেখছিলুম, ততই মনে হচ্ছিল, এখানে থাকলে সবাই-ই কবি হতে পারে, সাতকড়ি সাঁতার কোনও দোষ নেই। কেবল হতভাগা কাগামাছিটাই যদি না থাকত–
কিন্তু কোথায় কাগামাছি। আশেপাশে কোথাও তার টিকি কিংবা নাক-ফাক কিছু আছে বলে তো বোধ হচ্ছে না। তাহলে পাথরের গায়ে খড়ি দিয়ে ওসব লিখলই বা কে! কে জানে!
রাত হল, ড্রয়িংরূমে বসে আবার আমরা অনেক গল্প করলুম। সাতকড়ি আবার একটা বেশ লম্বা কবিতা আমাদের শোনালেন—আমরা বেড়াতে বেরুলে ওটা লিখেছেন। তার কয়েকটা লাইন এই রকম—
ওগো শ্যামল পাহাড়–
তোমার কী বা বাহার,
আমার মনে জাগাও দোলা
করো আমায় আপনভোলা
তুমি আমার ভাবের গোলা
জোগাও প্রাণের আহার—
টেনিদা বললে–পেটের আহার লিখলেও মন্দ হত না।
সাতকড়ি বললেন—তা-ও হত। তবে কিনা, পেটের আহারটা কবিতায় ভালো শোনায় না।
হাবুল জানাল—ভাবের গোলা না লেইখ্যা ধানের গোলাও লিখতে পারতেন।
এইসব উঁচুদরের কাব্যচর্চায় প্রায় নটা বাজল। তারপর প্রচুর আহার এবং দোতলায় উঠে সোজা কম্বলের তলায় লম্বা হয়ে পড়া।
নতুন জায়গা, সহজে ঘুম আসছিল না। আমরা কান পেতে বাইরে ঝিঝির ডাক আর দূরে ঝরনার শব্দ শুনছিলুম। ক্যাবলা হঠাৎ বলে উঠল—দ্যাখ, আমার কী রকম সন্দেহ হচ্ছে। জোয়ানের আরকের সঙ্গে থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি-ইয়ার্কি নাকি! তারপর লোকটা নিজেকে বলছে বৈজ্ঞানিক—অথচ সারা বাড়িতে একটাও সায়েন্সের বই দেখতে পেলুম না। খালি কতকগুলো বিলিতি মাসিকপত্র আর ডিটেকটিভ বই। আমার মনে হচ্ছে—
বলতে বলতে ক্যাবলা চমকে থেমে গেল—ওটা কিসের আওয়াজ রে!
কির-কির-কির পাশের বন্ধ ঘরটা থেকে একটা মেশিন চলবার মতো শব্দ উঠল। আর তারপরেই–
অন্ধকার ঘরের শাদা দেওয়ালে মাঝারি সাইজের ছবির ফ্রেমের মতো চতুষ্কোণ আলো পড়ল একটা। আরে এ কী! আমরা চারজনেই তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলুম-ছবি পড়ছে যে।
ছবি বই কি! সিনে ক্যামেরায় তোলা রঙিন ছবি! কিন্তু কী ছবি। এ কী—এ যে আমরাই। ম্যালে ঘুরছি—সিঞ্চলে সাতকড়ির সঙ্গে কথা কইছি—টেনিদা ক্যাবলাকে চাঁটি মারতে যাচ্ছে ঝাউবাংলোর নীচে আমাদের গাড়িটা এসে থামল।
তারপর আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা :
কাটা মুণ্ডুর নাচ দেখবে
শুনবে হাঁড়িচাঁচার ডাক
কাগামাছির প্যাঁচ দেখে নাও
একটু পরেই চিচিংফাঁক।
সব শেষে :
ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত হও।
–ঝুমুরলাল।
ফর কাগামাছি।
চৌকো আলোটা শাদা হয়ে দপ করে নিবে গেল। কির-কির করে আওয়াজটাও আর শোনা গেল না।
অন্ধকারে ক্যাবলাই চেঁচিয়ে উঠল—পাশের ঘর, পাশের ঘর! ওখান থেকেই প্রোজেক্টার চালিয়েছে।
টেনিদা আলো জ্বালাল। ক্যাবলা ছুটে গিয়ে পাশের বন্ধ ঘরের দরজায় লাথি মারল একটা।
দরজাটা খুলল না, ভেতর থেকে বন্ধ।
হাবুল ছুটে গিয়ে আমাদের ঘরের দরজা খুলতে গেল। সেটাও খুলল না। বাইরে থেকে কেউ শেকল বা তালা আটকে দিয়েছে বলে মনে হল।
০৭. কাটামুণ্ডুর নাচ
যতই টানাটানি করি আর চেঁচিয়ে গলা ফাটাই, দরজা আর কিছুতে খোলে না। শেষ পর্যন্ত হাবুল সেন থপ করে মেজের ওপরে বসে পড়ল।
—এই কাগামাছি অখন আমাগো মাছির মতন টপাটপ কইরা ধইরা খাইব।
—চার-চারটে লোককে গিলে খাবে-ইয়ার্কি নাকি? ক্যাবলা কখনও ঘাবড়ায় না। সে বললে–পুবদিকের জানলার কাছে বড় একটা গাছ রয়েছে টেনিদা। একটু চেষ্টা করলে সেই গাছ বেয়ে আমরা নেমে যেতে পারি।
আমি বললুমআর নামবার সঙ্গে সঙ্গে কাগামাছি আমাদের এক একজনকে–
–রেখে দে তোর কাগামাছি! সামনে আসুক না একবার, তারপর দেখা যাবে। টেনিদা তুমি আমাদের লিডার, তুমিই এগোও।
কনকনে শীত, বাইরে অন্ধকার, তার ওপর এই সব ঘোরতর রহস্যময় ব্যাপার। জানালা দিয়ে গাছের ওপর লাফিয়ে পড়াটড়া সিনেমায় মন্দ লাগে না, কিন্তু টেনিদার খুব উৎসাহ হচ্ছে বলে মনে হল না। মুখটাকে বেগুনভাজার মতো করে বললে–তারপর হাত-পা ভেঙে মরি। আর কি? ওসব ইন্দ্রলুপ্ত—মানে ধাষ্টামোর মধ্যে আমি নেই।