—নিজেরা তো দিব্যি খেলে, আর আমার বেলাতেই —
–আটটা পর্যন্ত ঘুমুতে কে বলেছিল, শুনি?—টেনিদা হুঙ্কার ছাড়ল।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, ওরাই দলে ভারি। টোস্টটা হাতে নিয়েই উঠে পড়লুম। সন্দেশ দুটোও ছাড়িনি, ভরে নিলুম জামার পকেটে। যাচ্ছি সেই নীলপাহাড়ির রহস্যময় ঝাউ-বাংলোয়, বরাতে কী আছে কে জানে। যদি বেঘোরে মারাই যেতে হয়, তাহলে মরবার আগে অন্তত সন্দেশ দুটো খেয়ে নিতে পারব।
শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের দুর্দান্ত অ্যাঁডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়লুম। আরও আধঘণ্টা পরেই।
দার্জিলিং রেল স্টেশনের পাশ থেকে আমাদের গাড়িটা ছাড়তেই টেনিদা হাঁক ছাড়ল—পটলডাঙা–
আমরা তিনজন তক্ষুনি শেয়ালের মতো কোরাসে বললুম—জিন্দাবাদ।
বজ্ৰবাহাদুর স্টিয়ারিং থেকে মুখ ফেরাল। তারপর তেমনি পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল—কী জিন্দাবাদ বললেন?
চারজনে একসঙ্গে জবাব দিলুম—পটলডাঙা।
–সে আবার কী?
লোকটা কী গেঁয়ো, আমাদের পটলডাঙার নাম পর্যন্ত শোনেনি। আর সেখানকার বিখ্যাত চারমূর্তি যে তার গাড়িতে চেপে একটা লোমহর্ষক অ্যাঁডভেঞ্চারে চলেছি, তা-ও বুঝতে পারছে না।
টেনিদা মুখটাকে স্রেফ গাজরের হালুয়ার মতো করে বললে–পটলডাঙা আমাদের মাদারল্যান্ড।
হাবুল বললে–উঁহু, ঠিক কইলা না। মাদারপাড়া।
—ওই হল, মাদারপাড়া। যাকে বলে—
ক্যাবলা বললে–ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস।
বজ্ৰবাহাদুর কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল, কী বুঝল সে-ই জানে। তারপর নিজের মনে কী একবার বিড়বিড় করে বলে গাড়ি চালাতে লাগল।
আমরাও মন দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে লাগলুম বসে বসে। পাহাড়ের বুকের ভেতর দিয়ে বাঁকে বাঁকে পথ চলেছে, কখনও চড়াই, কখনও উতরাই। কত গাছ, কত ফুল, কোথাও চা বাগান, কোথাও দুধের ফেনার মতো শাদা শাদা ঝরনা পথের তলা দিয়ে নীচেকুয়াশাঢাকা খাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঘুম বাঁ-দিকে রেখে পেশক রোড ধরে আমরা তিস্তার দিকে এগিয়ে চলেছি।
আমার গলায় আবার গান আসছিল—এমন শুভ্র নদী কাহার, কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়—কিন্তু বজ্ৰবাহাদূরের কথা ভেবেই সেই আকুল আবেগটা আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে হল। একেই লোকটার মেজাজ চড়া তার ওপর ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস শুনেই চটে রয়েছে। ওকে আর ঘাঁটানোটা ঠিক হবে না। পুবং-এর ঘি-দুধ খাওয়াবে বলেছে, তা ছাড়া গাড়ি তো ওরই হাতে। আমার গানের সুরে খেপে গিয়ে যদি একটু বাঁ দিকে গাড়িটা নামিয়ে দেয়, তা হলেই আর দেখতে হবে না। হাজার ফুট খাদ হা-হা করছে সেখানে।
হঠাৎ ক্যাবলা বললে–আচ্ছা টেনিদা?
—হুঁ।
—যদি গিয়ে দেখি সবটাই বোগাস?
–তার মানে?
মানে, ঝাউবাংলোয় সাতকড়ি সাঁতরা বলে কেউ নেই? ওই সবুজ দাড়িওয়ালা লোকটা আমাদের ঠকিয়েছে? রসিকতা করেছে আমাদের সঙ্গে!
টেনিদার সে-জন্য কোনও দুশ্চিন্তা দেখা গেল না। বরং খুশি হয়ে বললে–তা হলে তো বেঁচেই যাই। হাড়-হাবাতে কাগামাছির পাল্লায় আর পড়তে হয় না।
হাবুল বললে–কষ্টডাই সার হই।
–কষ্ট আবার, কিসের? বজ্ৰবাহাদুরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে টেনিদা বললে–পুবং-এর ছানা তা হলে আছে কী করতে?
গাড়িটা এবার ডানদিকে বাঁক নিলে। পথের দুধারে চলল সারবাঁধা পাইনের বন, টাইগার ফার্নের বন ঝোপ, থরে থরে শানাই ফুল। রাস্তাটা সরু-ছায়ায় অন্ধকার, রাশি রাশি প্রজাপতি উড়ছে। অত প্রজাপতি একসঙ্গে আমি কখনও দেখিনি। দার্জিলিং থেকে অন্তত মাইল বারো চলে এসেছি বলে মনে হল।
বজ্ৰবাহাদুর মুখ ফিরিয়ে বলল–নীলপাহাড়ি এরিয়ায় এসে গেছি আমরা।
নীলপাহাড়ি! আমরা চারজনেই নড়ে উঠলুম।
ঠিক তক্ষুনি ক্যাবলা বললে–টেনিদা, দেখেছ? ওই পাথরটার গায়ে খড়ি দিয়ে কী লেখা আছে?
গলা বাড়িয়ে আমরা দেখতে পেলুম, বড় বড় বাংলা হরফে লেখা : ছুঁচোবাজি।
সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা পাথরের দিকে আমার চোখ পড়ল। তাতে লেখা : কুণ্ডুমশাই।
হাবুল চেঁচিয়ে উঠল—আরে, এইখানে আবার লেইখ্যা রাখছে : হঁড়িচাঁচা।
টেনিদা বললে– ড্রাইভার সায়েব, গাড়ি থামান। শিগগির।
বজ্ৰবাহাদুর কটমট করে তাকাল—আমি ড্রাইভার নই, মালিক।
–আচ্ছা, আচ্ছা, তা-ই হল। থামান একটু।
–থামাচ্ছি। বলে তক্ষুনি থামাল না বভ্রুবাহাদুর। গাড়িটাকে আর-এক পাক ঘুরিয়ে নিয়ে ব্রেক কষল। তারপর বললে–নামুন। এই তো ঝাউ-বাংলা।
আমরা অবাক হয়ে দেখলুম, পাশেই একটা ছোট টিলার মতো উঁচু জায়গা। পাথরের অনেকগুলো সিঁড়ি উঠেছে সেইটে বেয়ে। আর সিঁড়িগুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে পাইন আর ফুলবাগানে ঘেরা চমৎকার একটি বাংলো। ছবির বইতে বিলিতি ঘরদোরের চেহারা যেমন দেখা যায়, ঠিক সেই রকম। চোখ যেন জুড়িয়ে গেল।
আমরা আরও দেখলুম, চোখে নীল গগ, বাঁদুরে টুপিতে মাথা মুখ ঢাকা, গায়ে ওভারকোট আর হাতে একটা লাঠি নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সাতকড়ি সাঁতরা।
বাঁদুরে টুপির ভেতর থেকে ভরাট মোটা গলার ডাক এল—এসো এসো! খোকারা, এসো! আমি তোমাদের জন্যে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি।
আর সেই সময় একটা দমকা হাওয়া উঠল, কী একটা কোত্থেকে খরখর করে আমার মুখে এসে পড়ল। আমি থাবা দিয়ে পাকড়ে নিয়ে দেখলুম, সেটা আর কিছুই নয়-চকোলেটের মোক।
০৬. বিনামূল্যে ফিল্ম শো
বজ্ৰবাহাদুর গাড়ি নিয়ে পুবং-এ চলে গেল।
যাওয়ার আগে বলে গেল কাল সকালে সে আবার আসবে। আমরা যদি কোথাও বেড়াতে যেতে চাই, নিয়ে যাবে। টেনিদা কিন্তু আসল কথা ভোলেনি। চেঁচিয়ে বললে–বাঃ, পুবং-এর মাখন?