আরে, এই তো তেরো নম্বর! উঁচু পাঁচিল-দেওয়া বাগানওলা একটা পুরনো বাড়ি। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে বাংলা হরফে নম্বর লেখা। গেট খোলাই আছে, কিন্তু ঢোকবার জো নেই। গেট জুড়ে খাটিয়া পেতে শুয়ে আছে পেল্লায় এক হিন্দুস্থানী দারোয়ান, তার হাতির মতো পেট দেখে মনে হল, সে বাঘা কুস্তিগির আর দারুণ জোয়ান—আমাদের চারজনকে সে এক কিলে চিড়ে-চ্যাপটা করে দিতে পারে।
আমরা চারজন এ-ওর মুখের দিকে তাকালুম। এই জগদ্দল লাশকে ঘাঁটানো কি ঠিক হবে?
টেনিদা একবার নাক-টাকগুলো চুলকে নিলে। চাপা গলায় বললে, পুঁদিচ্চেরি! তারপর আস্তে আস্তে ডাকল :
এ দারোয়ানজী!
কোনও সাড়া নেই।
ও দারোয়ান স্যার।
এবারেও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
পাঁড়ে মশাই!
দারোয়ান জাগল। ঘুমের ঘোরে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগল। আর তাই শুনেই আমরা চমকে উঠলুম।
দারোয়ান সমানে বলছিল : চাঁদ—চাঁদনি চক্রধর—চাঁদ—চাঁদনি–চক্রধর—
টেনিদা ফস করে বলে বসল : চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর।
কথাটা মুখ থেকে পড়তেই পেল না। তক্ষুনি—যেন ম্যাজিকের মতো উঠে বসল দারোয়ান। হড় হড় করে খাটিয়া সরিয়ে নিয়ে, আমাদের লম্বা সেলাম ঠুকে বললে, যাইয়ে—অন্দর যাইয়ে—
আমরা বোধহয় বোকার মতো মুখ চাওয়া-চাউয়ি করছিলুম। ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঠ্যাঙানি দেবে নাকি? যা রাক্ষসের মতো চেহারা, ওকে বিশ্বাস নেই।
দারোয়ান আবার মুচকি হেসে বললে, যাইয়ে—যাইয়ে–
এরপরে আর দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। আমরা দুরুদুরু বুকে দারোয়ানের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলুম। আর ঢুকতেই তক্ষুনি খাটিয়াটা টেনে গেট জুড়ে শুয়ে পড়ল দারোয়ান—যেন অঘোর ঘুমে ড়ুবে গেল।
কিন্তু আমরা কোথায় যাই?
সামনে একটা গাড়িবান্দাওলা লাল রঙের মস্ত দোতলা বাড়ি। জানলার সবুজ খড়খড়িগুলো সাদাটে হয়ে কবজা থেকে ঝুলে পড়ছে, তার গায়ের চুনবালির বার্নিশ খসে যাচ্ছে, তার মাথায় বট-অশ্বথের চারা গজিয়েছে। একটা ভালো ফুলের বাগান ছিল, এখন সেখানে আগাছার জঙ্গল। একটা মরকুটে লিচু গাছের ডগায় কে যেন আবার খামকা একটা কালো কাকতাড়ুয়ার হাঁড়ি বেঁধে রেখেছে।
আমরা এখানে কী করব বোঝবার আগেই বাড়ির ভেতরে থেকে তালট্যাঙা লোকটা—সেই যাকে আমরা চাঁদনির বাজারে দেখেছিলুম—মাছিমাকা গোঁফের নীচে মুচকি হাসি নিয়ে বেরিয়ে এল।
এই যে, এসে গেছেন! তিনটে বেজে দু সেকেন্ডবাঃ, ইউ অর ভেরি পাংচুয়েল।
আমরা চারজনে গা ঘেঁষে দাঁড়ালুম। যদি বিপদ কিছু ঘটেই, এক সঙ্গেই তার মোকাবেলা করতে হবে!
টেনিদা আমাদের হয়ে জবাব দিলে, আমরা সর্বদাই পাংচুয়াল।
গুড!-ভেরি গুড!—লোকটা এগিয়ে চলল, তা হলে আগে চলুন মা নেংটীশ্বরীর মন্দিরে। তিনি তো এ-যুগের সব চাইতে জাগ্রত দেবতা।
নেংটীশ্বরী!
লোকটা অবাক হয়ে ফিরে তাকালো : নাম শোনেননি? মা নেংটীশ্বরীর নাম শোনেননি? অথচ চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের খবর পেয়েছেন? এটা কী রকম হল?
আমরা বুঝতে পারছিলুম, একটা-কিছু গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। ক্যাবলা সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলে। না-না, নাম শুনব না কেন? না হলে আর এখানে এলুম কী করে?
তাই বলুন।—লোকটা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল; আমায় একেবারে ধোঁকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জয় মা নেংটীশ্বরী।
আমরাও সমস্বরে নেংটীশ্বরীর জয়ধ্বনি করলুম।
০৬. জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়
আমরা যেই বলেছি, জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়, সঙ্গে সঙ্গেই যেন চিচিংচন্দ্র ফাঁক হয়ে গেলেন। মানে, তক্ষুনি সেই সরু গুফো তালঢ্যাঙা চেহারার রোগা লোকটা হুড়মুড় করে একটা নকশাকাটা কালো দরজা টেনে খুলে ফেললে। আর সেই দরজা দিয়ে তাকিয়েই আমরা চারজনে একেবারে থ।
মা কালী, মা দুর্গা, রাধাকৃষ্ণ, লক্ষ্মী-সরস্বতী-বিশ্বকর্মা শীতলা-শিব, মায় ঘণ্টাকর্ণ ঠাকুর পর্যন্ত অনেক দেবতাই তো আমরা দেখেছি—মানে দেবতা আর কী করে দেখব, তাঁদের মূর্তিটুর্তি তো সব সময়েই দেখে থাকি। পাটনার সেই কংগ্রেস ময়দানে দেখেছি, বাঁশ, কাগজ আর সেই সঙ্গে আরও কী সব দিয়ে তৈরি রাবণ কুম্ভকর্ণ-ইন্দ্রজিতের আকাশ-ছোঁয়া মূর্তি-দশহরার দিন যাদের আগুনের তীর মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দরজা খুলতে আজ যা দেখতে পেলুম—এমন ঠাকুর এর আগে কোথাও কেউ দেখেছে বলে মনে হল না।
টেনিদা বিড়বিড় করে বললে, ডি লা গ্র্যান্ডি!
আমি বললুম, মেফিস্টোফিলিস!
হাবুল সেন বললে, খাইছে!
আর ক্যাবলা কিছুই বললে– না, হাঁ করে চেয়ে রইল, কেবল তার চশমাটা নাকের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়ল নীচের দিকে।
কী দেখলুম, সে আর কী বলব তোমাদের। ছোট্ট ঘরটা এই দিন-দুপুরেই অন্ধকার, তার ভেতরে মালার মতো করে লাল-নীল অনেকগুলো ইলেকট্রিকের বা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাগুলো মিটমিটে হলেও কটা এক সঙ্গে জ্বলছে বলে একটা অদ্ভুত রঙিন আলো থমথম করছে ঘরময়। সেই আলোয় চিকচিক করছে মস্ত একটা সিংহাসন রুপো-টুপো তাতে লাগানো আছে বোধহয়। সিংহাসনের মাথায় একটা সাদা ছাতা, আর সেই ছাতার তলায় ভেলভেটের গদিতে বসে—
স্বয়ং মা নেংটীশ্বরী। অথাৎ কিনা—ইয়া জাঁদরেল একটা নেংটি ইঁদুর।
নেংটি ইংদুরটার মূর্তি একটা ধুমসো হুলো বেড়ালের চাইতেও তিনগুণ বড়। সামনের পা দুটো জড়ো করে, কান খাড়া করে, ল্যাজটাকে পিঠের ওপর দিয়ে বাঁকিয়ে এমন কায়দায় বসে আছে যে আচমকা দেখলে জ্যান্ত বলে মনে হয়। চোখ দুটো বোধ করি কালো কাচ কিংবা পুঁতি দিয়ে তৈরি লাল-নীল আলোতে সে দুটো যেন শয়তানিতে চিকচিক করছে। তার সামনে একটা মস্ত বারকোশে ছোলা কলাবাতাসা-চাল-ডাল এই সব সাজানো রয়েছে, দেবী নেংটীশ্বরীর ভোগ নিশ্চয়।