ব্যাস, হলধরের সঙ্গে আলাপ এখানেই খতম। হলধর জানাকে আর জানা হল না—তার আগেই ঝাঁপের আড়ালে সে ভ্যানিসড।
সে তো ভ্যানিসড কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরে একেবারে চক্কর লাগিয়ে দিলে যাকে বলে। পচা চীনেবাদাম চিবুলে যেরকম লাগে, ঠিক সেই রকম বোকাবোকা হয়ে আমরা এ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলুম।
টেনিদা মাথা চুলকে বললে, ক্যাবলা—এবার?
ক্যাবলা বললে,। এখন চলো, কোথাও গিয়ে একটু চা খাই। সেখানে বসে প্ল্যান ঠিক করা যাবে।
কাছেই চায়ের দোকান ছিল একটা, নিরিবিলি কেবিনও পাওয়া গেল। ক্যাবলাই চা আর কেক আনতে বলে দিলে। এসব ব্যাপারে চিরকাল পয়সা-টয়সা ও-ই দেয়, আমাদের ভাববার কিছু ছিল না।
টেনিদা নাক চুলকে বললে, ব্যাপারটা খুব মেফিস্টোফিলিস বলে মনে হচ্ছে। মানে সাংঘাতিক। এত সাংঘাতিক যে পুঁদিচ্চেরিও বলা যেতে পারে।
হাবুল এতক্ষণ পরে মুখ খুলল :হ, সৈত্য কইছ।
চন্দ্রকান্ত আর নাকের শুনেই হলধর কী রকম লাফিয়ে উঠল দেখেছ?—আমি বললুম, তা হলে ছড়াটার দ্বিতীয় লাইনেরও একটা মানে আছে।
সব কিছুরই মানে আছে—বেশ গভীর মানে।–ক্যাবলা চায়ে চুমুক দিয়ে বললে, এখন তো দেখছি ছড়াটার মানে বুঝতে পারলেই কম্বলেরও হদিস পাওয়া যাবে।
টেনিদা এক কামড়েই নিজের কেকটাকে প্রায় শেষ করে ফলল। আমিও চট করে আমারটা আধখানা মুখে পুরে দিলুম, পাছে ওপাশ থেকে আমার প্লেটেও হাত বাড়ায়। টেনিদা আড় চোখে সেটা দেখল, তারপর ব্যাজার হয়ে বললে, কিন্তু পটলডাঙার কম্বল কী করে যে চাঁদনির বাজারে এল আর চক্রধরের সঙ্গে জুটলই বা কী ভাবে, সেইটেই বোঝা যাচ্ছে না।
সেটা বুঝলে তো সবই বোঝা যেত।—ক্যাবলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল :
ভেবেছিলুম, কম্বলের পালানোটা কিছুই নয়—এখন দেখছি বদ্রীবাবুই ঠিক বলেছিলেন। কম্বল চাঁদে হয়তো যায়নি, কিন্তু যে রহস্যময় চাঁদোয়ার তলায় সে ঘাপটি মেরে বসে আছে সে-ও খুব সোজা জায়গা নয়। ওয়েল, টেনিদা।
ইয়েস ক্যাবলা।
চলো, আমরা চারজনে চারিদিক থেকে চক্রধরের দোকানের ওপর নজর রাখি। আমাদের তাড়াবার জন্যেই হলধর দোকান বন্ধ করছিল, আবার নিশ্চয় ঝাঁপ খুলবে। দেখতে হবে ঝোল্লা গোঁফ আর কপালে আব নিয়ে কটকটে কালো চক্রধর আসে কি না কিংবা লম্বা নাক নিয়ে চন্দ্রকান্ত দেখা দেয় কি না। কিন্তু টেক কেয়ার—সব্বাইকেই একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে—হলধর যাতে কাউকে দেখতে না পায়।
আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলুম।
ক্যাবলা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়াতে ওর বাবা ওকে একটা হাতঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সেটার দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা বললে, এখন সাড়ে চারটে। পড়াশুনোর সময় নষ্ট না করেও আমরা আরও দেড় ঘণ্টা থাকতে পারি এখানে। কে জানে, হয়তো আজকেই কোনও একটা কু পেয়ে যেতে পারি কম্বলের। ফ্রেন্ডসনাউ টু অ্যাঁকশান—এবার কাজে লাগা যেতে পারে।
চাঁদনির বাজারে এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকা কিছু শক্ত কাজ নয়। আমরাও পাকা গোয়েন্দার মতো চারিদিকে চারটে জায়গা বেছে নিয়ে চক্রধরের দোকানের দিকে ঠায় চেয়ে রইলুম। টেনিদা আর ক্যাবলাকে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ঠিক আমার মুখোমুখি একটা লোহার দোকানের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে কচ্ছপের মতো গলা বের করছিল হাবুল।
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি, চক্রধরের দোকানের ঝাঁপ আর খোলে না। চোখ টনটন করতে লাগল, পা ব্যথা হয়ে গেল। এমন সময়, হঠাৎ পেছন থেকে আমার কাঁধে কে যেন টুক টুক করে দুটো টোকা মারল।
চমকে তাকিয়েই দেখি, ছিটের শার্ট গায়ে, ঢ্যাঙা তালগাছের মতো চেহারা, নাকের নীচে মাছিমাকা গোঁফ, বেশ ওস্তাদ চেহারার লোক একজন। মিটমিট করে হেসে বললে, ছল ছল খালের জল—তাই না?
আমি এত অবাক হয়ে গেলুম যে মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না।
লোকটা বলল, তা হলে হলধরকে নিয়ে আর সময় নষ্ট করা কেন? কাল বেলা তিনটের সময় তেরো নম্বর শেয়ালপুকুর রোডে গেলেই তো হয়।
বলে আমার পিঠে টকটক করে আবার গোটা দুই টোকা দিয়ে, টুক করে কোনদিকে সরে পড়ল যে।
০৫. কলকাতায় কাঁটাপুকুর আছে
কলকাতায় কাঁটাপুকুর আছে, ফড়েপুকুর আছে, বেনেপুকুর, মনোহরপুকুর, পদ্মপুকুর সব আছে, কিন্তু শেয়ালপুকুর আবার কোন্ চুলোয়! হিসেবমতো শেয়ালদার কাছাকাছিই তার থাকা উচিত, কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া গেল না পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় কলকাতার রাস্তার যে-লিস্টি থাকে, তাই থেকেই শেষ পর্যন্ত জানা গেল, শেয়ালপুকুর সত্যিই আছে দক্ষিণের শহরতলিতে। জায়গাটা ঠিক কোনখানে, তা আর তোমাদের নাই বললুম।
শেয়ালপুকুরের সন্ধান তো পাওয়া গেল, তেরো নম্বরও নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হল, জায়গাটাতে আদৌ যাওয়া উচিত হবে কি না? কাঁটাপুকুরে কোনও কাঁটা নেই—সে আমি দেখেছি; মনোহরপুকুরে আমার মাসতুতো ভাই লোটনদা থাকে সেখানে কোনও মনোহরপুকুর আমি দেখিনি, ফড়েপুকুরেও নিশ্চয়ই ফড়েরা সাঁতরে বেড়ায় না। শেয়ালপুকুরের চারপাশেও খুব সম্ভব এখন আর শেয়ালের আস্তানা নেই—বেলা তিনটের সময় সেখানে গেলে নিশ্চয়ই আমাদের খ্যাঁক-খ্যাঁক করে কামড়ে দেবে না। কিন্তু–
কিন্তু চাঁদনির সেই সন্দেহজনক আবহাওয়া? সেই ঝোল্লা গোঁফ আর কপালে আবওলা চক্রধর সামন্ত কিংবা সেই নাকেশ্বর চন্দ্রকান্ত—যাদের এখনও আমরা দেখিনি? সেই তেলেভাজা-খাওয়া হলধর আর তালঢ্যাঙা সেই খলিফা-চেহারার লোকটা? এসবের মানে কী? ছড়াটা দেখছি ওরা সবাই ই জানে আর এই ছড়ার ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনও সাংকেতিক রহস্য। পটলডাঙার বিচ্ছুমাকা কম্বল ও-ছড়াটা পেলেই বা কোথায়, আর কারাই বা তাকে নিরুদ্দেশ করল?