হাবুল বললে, টেনিদা, অখন কী করন যাইব?
ক্যাবলা বললে, করবার কাজ তো একটাই রয়েছে। অর্থাৎ এখন সোজা ওখানে গিয়ে চক্রধর সামন্তের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, দেখা করে কী বলবি?
টেনিদা পেছন থেকে আমার মাথায় টুক করে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে : চক্রধর সামন্তকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে লুচি-পোলাও খাইয়ে দিবি। দেখা করে কী আবার বলব? পরিষ্কার জানতে চাইব, এই কবিতাটার মানে কী, আর শ্রীমান কম্বল কোথায় আছেন।
ক্যাবলা ছুটে গিয়ে বললে, হুঁ, তাহলেই সব কাজ চমৎকার ভাবে পণ্ড হতে পারবে। কম্বলকে যদি এরাই কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকে, সঙ্গে সঙ্গেই হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। হয়তো কম্বলকে আমরা আর কোনওদিন খুঁজেই বের করতে পারব না।
হাবুল বললে, না পাইলেই বা কী হইব। সেই পোলাখান না? সে হইল গিয়া এক। নম্বরের বিচ্ছু। তারে ধইর্যা যদি কেউ চান্দে চালান কইর্যা দেয়, দুই দিনে চান্দের গলা দিয়াও কান্দন বাইরাইব।
টেনিদা ধমকে বললে, তুই থাম। কম্বল যত অখাদ্য ছেলেই হোক, তার কাকার কাছে আমরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য, মানে ডিউটি বাউন্ড। তারপর বদ্রীবাবু পিটিয়ে কম্বলের ধুলো ওড়ান কি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েই পড়ন—সে তিনিই বুঝবেন। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ বকবক করব আমরা? কিছু একটা করতে তো হবে।
ক্যাবলা বলল, আলবাত করতে হবে। চলো, আমরা মাছধরার ছিপ-সুতো এই সব খোঁজ করিগে।
আমি চ্যাঁ-চ্যাঁ শব্দে প্রতিবাদ করে বললুম, আমি কিন্তু ছিপ সুতো নিয়ে বাড়ি যাব না। মেজদা তা হলে আমার কান কেটে নেবে।
তোর কান কেটে নেওয়াই উচিত-চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে কটকটিয়ে তাকাল ক্যাবলা : আরে বোকারাম, ছিপসুতো কিনছে কে? আমরা এটা-ওটা বলে হালচাল বুঝে নেব।
টেনিদা খুব মুরব্বীর মতো বললে, প্যালা আর হাবলাকে নিয়েই মুস্কিল। এ-দুটোর তো মাথা নয়—যেন এক জোড়া খাজা কাঁটাল। কী বলতে কী বলবে আর সব মাটি হয়ে যাবে। শোন, তোরা দুজন একেবারে চুপ করে থাকবি, বুঝেছিস? যা বলবার আমরাই বলব—মানে আমি আর ক্যাবলা। মনে থাকবে?
আমরা গোঁজ হয়ে ঘাড় নাড়লুম। মনে থাকবে বই কি। এদিকে কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছিল টেনিদার ওপর। বলতে ইচ্ছা করছিল, আমাদের মাথা নয় খাজা কাঁটাল, আর তোমার? পণ্ডিত মশাই বলতেন না, বৎস টেনিরাম, ওরফে ভজহরি, জগদীশ্বর কি তোমার স্কন্ধের উপর মস্তকের বদলে একটি গোময়ের হাঁড়ি বসাইয়া দিয়াছেন? রাগ হলেই তাঁর মুখ দিয়ে সাধুভাষা বেরিয়ে আসত।
সে যাই হোক, আমরা তো চক্রধর সামন্তের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে আঠারো-উনিশ বছরের একটা ছেলে খাকী হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরে একটা শালপাতার ঠোঙা থেকে তেলেভাজা খাচ্ছিল।
আমাদের দেখেই বেগুনি চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলে, কী চাই?
ক্যাবলা বললে, আমরা ছিপ কিনব।
ওই তো রয়েছে, পছন্দ করুন না বলে সে আবার একটা আলুর চপে কামড় বসাল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, ছিপ বিক্রি করার চাইতে তেলেভাজাতেই মনোযোগ তার বেশি।
আপনিই বুঝি চক্রধরবাবু?—টেনিদা ভারি নরমনরম গলায় ভাব করবার মতো করে জানতে চাইল।
আমি চক্রধরবাবু হতে যাব কেন?—আলুর চপের ভেতরে একটা লঙ্কা চিবিয়ে ফেলে বিচ্ছিরি মুখ করল ছেলেটা :
তিনি তো আমার মামা।
ক্যাবলা বললে, ঠিক-ঠিক। তাই চক্রধরবাবুর মুখের সঙ্গে আপনার মুখের মিল আছে! ভাগনে বলেই।
ভাগনে এবার চটে উঠল, শুনে আলুর চপের মতো ঘোরালো হয়ে উঠল তার মুখ। খ্যাঁকখ্যাঁক করে বললে, কীকার মুখের সঙ্গে মিল আছে বললেন? চক্ৰধরের? সে সাত পুরুষে আমার মামা হতে যাবে কেন? গাঁয়ের লোকে তাকে মামা বলে—আমিও বলি। আমার মুখ তার মতো ভীমরুলের চাকের মতো? আমার কপালে তার মতো আব আছে? আমার রং তার মতো কটকটে কালো? আমার নাকের তলায় একটা ঝোল্লা গোঁফ দেখতে পাচ্ছেন?
ক্যাবলার মতো চটপটে ছেলেও কী রকম ঘাবড়ে গেল এবার। বার দুই বিষম খেলে।
মানে—এই ইয়ে—
ইয়ে-টিয়ে নেই। ছিপ কিনতে এসেছেন কিনুন, নইলে ঝাঁ করে সরে পড়ুন এখান থেকে। খামকা যা তা বলে মেজাজ খারাপ করে দেবেন না স্যার।
সে তো বটেই, সে বটেই।—টেনিদা মাথা নাড়ল : ওর কথা ছেড়ে দিন মশাই, ওটা কী বলে ইয়ে মানে নেহাত নাবালক। আপনার মুখখানা—মানে—ঠিক চাঁদের মতো—অর্থাৎ কিনা চন্দ্রকান্ত বাবুও বলা যায় আপনাকে।
আমার নাম হলধর জানা।–বলেই সে হঠাৎ কী রকম চমকে উঠল : কী নাম বললেন? চন্দ্রকান্ত?
টেনিদা ফস করে বলে বসল : নিশ্চয় চন্দ্রকান্ত। এমন কি আপনার টিকোলো নাক দেখে নাকেশ্বর বলতেও ইচ্ছে করছে।
কী বললেন? নাকেশ্বর? চন্দ্রকান্ত-নাকেশ্বর?—হলধর জানা তেলেভাজার ঠোঙাটা মুড়ে ফেলে দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : আপনারা যান। ছিপ বিক্রি হবে না। দোকান বন্ধ।
ক্যাবলা বললে, দোকান বন্ধ।
হ্যাঁ, বন্ধ। হলধর কী রকম বিড়বিড় করতে লাগল : আজকে বিষুব্বর না? বিষুদবারে আমাদের দোকান বন্ধ থাকে।
মোটেই না, আজকে মঙ্গলবার—আমি প্রতিবাদ করলুম।
হোক মঙ্গলবার—হলধর কাঁচা উচ্ছে চিবুনোর মতো মুখ করে বললে, আমরা মঙ্গলবারেও দোকান বন্ধ করে রাখি। বলেই সে ঘটাং ঘটাং করে আমাদের নাকের সামনেই ঝাঁপ বন্ধ করে দিলে। তারপর একটা ফুটোর ভেতর দিয়ে নাক বের করে বললে, অন্য দোকানে গিয়ে ছিপ কিনুন, এখানে সুবিধে হবে না।