হাবুল সেন বললে, আর দশ কিলো ওজনের একখানা পচা কাঁঠাল পড়লে সকলেরেই ধরাশায়ী কইর্যা দিব। যদি আত্মরক্ষা কোরতে চাও, অবিলম্বে এইখান থিক্যা পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর।
যুক্তিটা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, আমরা আর দাড়ালুম না। চটপট পা চালিয়ে একেবারে চাটুজ্যেদের রকে।
টেনিদা কি বলতে যাচ্ছিল, ক্যাবলা বললে, না—এখানে নয়। রাস্তার ধারে বসে কোনও সিরিয়াস আলোচনা করা যায় না। চলো আমাদের বৈঠকখানায়। বাবা টুরে বেরিয়েছেন, কাকা গেছেন দিল্লিতে, বেশ নিরিবিলিতে বসে সব প্ল্যান ঠিক করা যাবে।
প্রস্তাবে আমরা একবাক্যে রাজি হয়ে গেলুম। সত্যিই তো, এখন আমাদের খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। শত্রুর চর সব সময় আমাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখছে কি না, কিছুই তো বলা যায় না। তা ছাড়া ক্যাবলার মা নানারকম খাবার করতে ভালোবাসেন, খাওয়াতেও ভালোবাসেন তাঁকেও তো একটু খুশি করা দরকার।
তা খাওয়াটা মন্দ জমল না। ক্যাবলার মা কেক তৈরি করছিলেন, গরম গরম আমাদের কেটে এনে দিলেন। হট কেকের সঙ্গে চাটা খেয়ে আমাদের মেজাজ খুলে গেল।
টেনিদা আমাদের লিডার বটে, কিন্তু সে অ্যাঁকশনের সময়। মাথা ঠাণ্ডা করে বুদ্ধি জোগাবার বেলায় ওই খুদে চেহারার ক্যাবলা মিত্তির। তা না হলে কি আর টপাটপ পরীক্ষায় স্কলারশিপ পায়!
ক্যাবলা প্রথমেই পকেট থেকে কম্বলের লেখার সেই নকলটা বের করল।
—টেনিদা, এই লেখাটার মধ্যে একটা সূত্র আছে মনে হয়।
টেনিদা বললে, আহা, সূত্র তো বটেই। পরিষ্কার লিখছে, নিরুদ্দেশ হচ্ছি। মাস্টারের ঠ্যাঙানি খাওয়ার ভয়ে যেদিকে হোক লম্বা দিয়েছে। কিন্তু কম্বলের মতো একটা অখাদ্য জীব চাঁদে গেছে, এ হতেই পারে না। আমি কখনও বিশ্বাস করব না—তা বদ্রীবাবুই বলুক আর কেদারবাবুই বলুক।
ক্যাবলা হিন্দী করে বললে, এ জী, জেরা ঠহরো না। আরে চাঁদ-উদ ছোড় দো, উতো বিলকুল দিল্লাগী মালুম হচ্ছে আমার, নীচের লেখাগুলোই একটু ভালো করে দেখা দরকার। ওদের কোনও মানে আছে।
আমি বললুম, ওই চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর? তোর মাথা খারাপ হয়েছে ক্যাবলা। ওগুলো স্রেফ পাগলামি, ওদের কোনও মানেই হয় না।
বেশি ওস্তাদি করিসনি প্যালা, আমি কী বলছি তাই শোন। কম্বলকে আমরা সকলেই জানি। তার বিদ্যেবুদ্ধির দৌড়ও আমাদের অজানা নয়। সেদিনও সে আমায় জিজ্ঞেস করছিল, ইটালীর মুসোলিনী কি বেলাঘাটার মৃণালিনী মাসিমার বড় বোন? তার হাতের লেখা দেখলে উর্দু কিংবা কানাড়ী বলে মনে হতে থাকে। বন্ধুগণ একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যাকে স্রেফ পাগলামি বলে মনে হচ্ছে, তা হল লাইনের একটি কবিতা। তাতে ছন্দ আছে, মিলও আছে। কম্বলের সাধ্যও নেই ওভাবে ছন্দ মিলিয়ে, মিল রেখে, ছটা লাইন দাঁড় করায়।
হাবুল মাথা নাড়ল : হ, বুঝছি। আর কেউ লেইখ্যা দিছে।
ঠিক, আর কেউ দিয়েছে। কিন্তু খামকা লিখতে গেল কেন? নিশ্চয়ই ওর একটা মানে আছে।ক্যাবলা কাগজটা খুলে ধরে পড়তে লাগল : চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর। নিরাকার মোষের দল—আচ্ছা টেনিদা?
টেনিদা বললে, ইয়েস।
আমার মাথায় প্ল্যান এসেছে একটা। একবার চাঁদনির বাজারে যাবে।
চাঁদনির বাজার!—আমরা তিনজনে একসঙ্গে চমকে উঠলুম। টেনিদা নাক কুঁচকে, মুখটাকে শোনপাপড়ির মতো করে বললে, কী জ্বালা, চাঁদনির বাজারে যেতে যাব কেন?
ক্যাবলা আরও বেশি গম্ভীর হল।
ধরো, সেখানে যদি চক্রধরকে পেয়ে যাই? কিংবা কে জানে চন্দ্ৰকান্তের সঙ্গেই দেখা হয়ে যেতে পারে হয়তো।
নাকেশ্বর বইস্যা থাকতে পারে—কেডা কইব?—হাবুল জুড়ে দিলে।
সবই হতে পারে-ক্যাবলা বললে, চলো না টেনিদা, ঘুরেই আসি একটু। যদি কোনও খোঁজ না-ই পাওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কী। ছুটির দিন, একটু বেড়িয়েই নয় আসা যাবে।
কিন্তু বেড়াবি কোথায়?—টেনিদা বিরক্ত হল : চাঁদনি তো আর একটুখানি জায়গা নয়। সেখানে চক্রধর বলে কেউ যদি থাকেই, তাকে কী করে খুঁজে পাওয়া যাবে?
এক পাল খড়ের ভেতর থেকে গোয়েন্দারা ছুঁচ খুঁজে বের করতে পারে, আর চাঁদনি থেকে একটা লোককে আমরা খুঁজে পাব না? এই কি আমাদের লিডারের মতো কথা হল? ছি-ছি, বহুৎ শরম কি বাত!
আর বলতে হল না তড়াক করে টেনিদা লাফিয়ে উঠল : চল তা হলে, দেখাই যাক একবার।
আমরা বেরিয়ে পড়লুম। চীনেবাদাম খেতে খেতে যখন চাঁদনির বাজারে যাওয়ার জন্যে ট্রাম চাপলুম, তখনও আমরা কেউ ভাবিনি যে সত্যি-সত্যিই আমরা এবার একটা রহস্যের খাসমহলের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। আমাদের সামনে এমন দুরন্ত অভিযান ঘনিয়ে আসবে।
চাঁদনির বাজারে ঢুকে টেনিদা কেবল এক ভদ্রলোককে বোকার মতো জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, মশাই, এখানে চক্রধর বলে কেউ-হঠাৎ হাবুল থাবা মেরে তাকে থামিয়ে দিলে। বললে– টেনিদা—টেনিদা—ওই যে! লুক দেয়ার!
একটি ছোট সাইনবোর্ড। ওপরে বড়বড় অক্ষরে : শ্রীচক্রধর সামন্ত। মৎস ধরিবার সর্বপ্রকার সরঞ্জাম বিক্রেতা। পরিক্ষা প্রার্থনীয়।
অবশ্য মৎস্যে য-ফল্য নেই, তাছাড়া লেখা রয়েছে পরিক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু তখন বানান ভুল ধরার মতো মনের অবস্থা ক্যাবলার মতো পণ্ডিতেরও নেই। আমরা চারজনেই হাঁ করে সাইনবোর্ডটার দিকে চেয়ে রইলুম কেবল।
০৪. সাইনবোর্ডে যতই বানান ভুল থাক
সাইনবোর্ডে যতই বানান ভুল থাক, মানে মৎসই লিখুক আর পরিক্ষাই চালিয়ে দিক, আসল ব্যাপার হল : এটা চাঁদনির বাজার আর চক্রধর সামন্তের দোকান একেবারে সামনেই রয়েছে। অর্থাৎ কবিতাটার প্রথম দু লাইনের মানে এখানেই পাওয়া যাচ্ছে যে।