একসারসাইজ বুকের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার ওপর শ্রীমান কম্বল তাঁর দেবাক্ষর সাজিয়েছেন। প্রথমে মনে হল, কতগুলো ছাতারে পাখি এঁকেছে বোধহয়। তারপরে ক্রমে ক্রমে পাঠোদ্ধার করে যা দাঁড়াল, এই রকম :
আমি নিরুদ্দেশ। দূরে বহু দূরে চলিলাম। লোটা কম্বলও লইলাম না! আর ফিরিব। ইতিকম্বলচন্দ্র।
এই চিঠির নীচে আবার কতকগুলো সাংকেতিক লেখা :
চাঁদ—চাঁদনি–চক্রধর। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর। নিরাকার মোষের দল। ছল ছল খালের জল। ত্রিভুবন থর-থর। চাঁদে চড়—চাঁদে চড়।
সেগুলো পড়ে আমরা তো থ।
বদ্রীবাবু মুচকি হেসে বললেন, কেমন, বিশ্বাস হল তো? চাঁদে চড়—চাঁদে চড়, নির্ঘাত চড়ে বসেছে। এমন কি, ইতি লিখে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে নামের আগে, দেখতে পাচ্ছ না? তার মানে কী? মানে-স্বর্গীয় হয়নি, চন্দ্রলোকে—
ক্যাবলা বললে, হুঁ, নিশ্চয় চন্দ্রলোকে। তা আমরা এই লেখাটার একটা কপি পেতে পারি?
নিশ্চয়-নিশ্চয়। তাতে আর আপত্তি কী!
ক্যাবলার হাতের লেখা ভালো, সেই ওটা টুকে নিলে। তারপর উঠে দাঁড়াল টেনিদা।
তা হলে আসি আমরা। কিছু ভাববেন না বদ্রীবাবু। শিগগিরই কম্বলকে আপনার হাতে এনে দেব।
এনে দিতেও পারো, না দিলেও ক্ষতি নেইবদ্রীবাবু হাই তুললেন : সত্যি বলতে কী, ওটা এমনি অখাদ্য ছেলে যে আমার ওর ওপরে অরুচি ধরে গেছে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করব! তোমরা কম্বলকে খুঁজে বের করতে চাও কেন? সে কি তোমাদের কারও কিছু নিয়ে সটকান দিয়েছে?
টেনিদা বললে, আজ্ঞে না, কিছুই নেয়নি। আর নেবার ইচ্ছে থাকলেও নিতে পারত না—আমরা অত কাঁচা ছেলে নই। কম্বলকে আমরা খুঁজতে বেরিয়েছি নিতান্তই নিঃস্বার্থ পরোপকারের জন্যে।
পরোপকারের জন্যে! এ-যুগেও ওসব কেউ করে নাকি? বদ্রীবাবু খানিকক্ষণ হাঁ করা কাকের মতো চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে : তোমরা তো দেখছি সাংঘাতিক ছেলে। তা ভবিষ্যতে গুড ক্যারাক্টারের সার্টিফিকেট দরকার থাকলে এসো আমার কাছে, আমি খুব ভালো করে লিখে দেব।
আজ্ঞে, আসব বই কি–ক্যাবলা খুব বিনীতভাবে একথা বলবার পর আমরা বদ্রীবাবুর প্রেস থেকে বেরিয়ে এলুম। রাস্তায় নেমে কেলব কয়েক পা হেঁটেছি, এমন-সময়—
বোঁ-ও-ও
টেনিদার ঠিক কান ঘেঁষে কামানের গোলার মতো একটা পচা আম ছুটে বেরিয়ে গেল—ফাটল গিয়ে সামনে ঘোষেদের দেওয়ালে। খানিকটা দুর্গন্ধ কালচে রস পড়তে লাগল দেওয়াল বেয়ে। ওইটে টেনিদার মাথায় ফাটলে আর দেখতে হত না—নির্ঘাত নাইয়ে ছাড়ত।
তক্ষুনি আমরা বুঝতে পারলুম, কম্বলের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছন আছে কোনও গভীর চক্রান্তজাল, আর এরই মধ্যে আমাদের ওপর শত্রুপক্ষের আক্রমণ শুরু হয়েছে।
০৩. আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম
আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম। তারপর টেনিদা মোটা গলায় বললে, হুঁ, উড়ম্বর।
উড়ম্বর?—আমি অবাক হয়ে বললুম, তার মানে কী?
মানে উড়ন্ত আক্রমণ—অম্বর হইতে। টেনিদা আরও গম্ভীর হয়ে বললে।
ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হতেই পারে না। আর অম্বর হইতে উড়ন্ত আক্রমণ—এ কিছুতেই উড়ম্বরের ব্যাসবাক্য নয়। তাছাড়া উড়ম্বর মানে—
শাটাপ-তক্কো করবি না আমার সঙ্গে। টেনিদা দুমদাম করে পা ঠুকল : আমি যা বলব তাই কারেকট, তাই গ্রামার। আমি যদি ক্যাবলা মিত্তির সমাস করে বলি, মিত্তির হইয়াছে যে ক্যাবলাসুপসুপা সমাস, তা হলে কে প্রতিবাদ করে তাকে একবার আমি দেখতে চাই।
বেগতিক বুঝে ক্যাবলা চশমাসুদ্ধ নাকটাকে আকাশের দিকে তুলে চিল-ফিল কী সব দেখতে লাগল, কোনও জবাব দিলে না। হাবুল সেন বললে, না, তারে দ্যাখতে পাইবা না। গাঁট্টা খাওনের লাইগা কারই বা চাঁদি সুড় সুড় কোরতেছে? কী কস প্যালা, সৈত্য কই নাই?
আমি হাবুলের মতোই ঢাকাই ভাষায় জবাব দিলুম, হঃ, সৈত্যই কইছস।
টেনিদা বললে, না, এখন বাজে কথা নয়। গোড়াতেই দেখছি ব্যাপার বেশ পুঁদিচ্চেরিমানে, দস্তুরমতো ঘোরালো। অথাৎ কম্বল মাস্টারের থাপ্পড়ের ভয়েই পালাক আর চাঁদে চড়বার চেষ্টাই করুক, সে নিশ্চয় কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তা না হলে একটা পচা আম অমন ভাবে আমার কান তাক করে ছুটে আসত না। বুঝেছিস, ওটা হল ওয়ার্নিং। যেন বলতে চাইছে, টেক কেয়ার, কম্বলের ব্যাপারে তোমরা নাক গলাতে চেয়ো না।
আমি বললুম, তা হলে আমটা ছুঁড়ল কে?
টেনিদা একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল, যাকে বাংলায় বলে হাই ক্লাস। তারপরে নাকটাকে কী রকম একটা ফুলকপির সিঙাড়ার মতো চোখা করে বললে, তা যদি এখুনি জানতে পারতি রে প্যালা, তা হলে তো রহস্যকাহিনীর প্রথম পাতাতেই সব রহস্য ভেদ হয়ে যেত। যেদিন কম্বলকে পাকড়াতে পারব, সেদিন আম কে ছুঁড়েছে তা-ও বুঝতে বাকি থাকবে না।
বললুম, আচ্ছা, ছাতে ওই যে কাকটা বসে রয়েছে, ওর মুখ থেকেও তো হঠাৎ আমটা—
ক্যাবলা বললে, বাজে বকিসনি। কাকে এক-আধটা আমের আঁটি ঠোঁটে করে হয়তো নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অত বড় একটা আম তুলতে পারে কখন? আর মনে কর, যদি ওই কাকটাকে ওয়েট লিফটিং চ্যাম্পিয়ন—মানে ওদের মধ্যেই ধরা যায়, তা হলেও কি আমটা ও বুলেটের মতো ছুঁড়ে দিতে পারে?
হাবুল ঘাড় নেড়ে বললে– যে কাগটা আম ফেইক্যা মারছে, সে হইল গিয়া ডিসকাস-থোয়িং-এর চ্যাম্পিয়ান।
টেনিদা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার আর হাবুলের মাথা কটাং করে একসঙ্গে ঠুকে দিলে। খুব খারাপ মুখ করে বললে, আরে গেল যা। এদিকে দিবা-দ্বিপ্রহরে কলকাতা শহরে আমার ওপর শত্রুর আক্রমণ আর এ দুটোতে সমানে কুরুবকের মতো বক বক করছে। শোন—একটাও আর বাজে কথা নয়। আমটা যে আমার দিকেই তাক করে ছোড়া হয়েছে। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কোন্ বাড়ি থেকে ছুঁড়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু খামকা আমার সঙ্গে লাগতে সাহস করবে, এমন বুকের পাটাও এ-পাড়ায় কারও নেই। টেনি শমাকে সকলেই চেনে। অতএব প্রতিপক্ষ অতিশয় প্রবল। সেইজন্যে মনে হচ্ছে, এখন। পচা আম পড়েছে, একটু পরে ধপাৎ করে একটা পেঁপেও পড়তে পারে। আর বড় সাইজের তেমন-তেমন একখানা পেঁপে যদি হয়, তা হলে সে চিজ যারই মাথায় পড়ক, আমরা কেউই অনাহত থাকব না।