ঘরসুদ্ধ লোক একদম চুপ। চন্দ্রকান্ত, বিবেন, দুটো চাকর—চোখ কপালে তুলে পাথর হয়ে রইল। টেনিদা বললে, কী মাশ্চটক মশাই, আমাকে মেরামত করবেন না?
খগেন মাশ্চটক একবার ওঠবার চেষ্টা করেই আবার ধপাৎ করে শুয়ে পড়ল। কেবল বললে, গাং-ওফ্-ফ।
হঠাৎ বিলেবন লাফিয়ে উঠল : চন্দর দা—দেখচ কী? এরা খুদে ডাকাতের দল। খগেনের মতো অত বড় লাশকেও অমন করে শুইয়ে দিলে? আমি দলের আরও লোকজন ডাকি–সবাই মিলে ওদের–
টেনিদা আস্তিন গুটিয়ে বললে, কাম অন–সঙ্গে সঙ্গে আমরা তিনজনও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম লিডারের পাশে। বললুম, কাম অন—কাম অন—
হাবুল আমার কানে কানে বললে, অখন আরও মজা হইব।
ঠিক তখন—
ঠিক তখন বন্ধ দরজার গায়ে ঝনঝন করে ঘা পড়ল। কে যেন মোটা গলায় ডাক দিয়ে বললে, পুলিশ—শিগগির দরজা খোলো—
১১. চাঁদ-চাঁদনির রহস্য
চাঁদ-চাঁদনির রহস্য তো বোঝা গেল। আসলে চোরাকারবারীর এক বিরাট দল—ওই ছড়াই হল ওদের সাংকেতিক বাক্য। ছড়া বলতে পারলে আর চক্রধর সামন্তের দোকানে একবার গিয়ে পৌঁছতে পারলেই ওরা তাকে চিনে নেয় নিজের লোক বলে। তারপরে সব একসুতোয় গাঁথা। শেয়ালপুকুরের বাড়ি, গুরু বিটকেলানন্দ, দেবী নেংটীশ্বরী সব জলের মতো সোজা। ম্যাও ম্যাও যে কেন হানা দেয়, কেন ঝোল্লা গোঁফ আর আব নিয়ে চক্রধর কম্বলের তলায় শুয়ে পড়ে সব পরিষ্কার। তারপর ছল ছল খালের জল, নিরাকার মোষের দল থেকে একেবারে মহিষাদল—একদম আদত ঘাঁটিতে।
সব রহস্যের সমাধান। জিয়োমেট্রিতে যাকে বলে কিউ-ই-ডিঅর্থাৎ কিনা—ইহাই উপপাদ্য বিষয়।
ক্যাবলা আগে থেকেই হুঁশিয়ার। তার যে মামা পুলিশে চাকরি করে, গোড়াগুড়িই তাঁকে সব খবর সে জুগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি শুনে বলেছিলেন, বদমায়েসদের একটা গ্যাং আছে। এবার ধরে ফেলব। তোরা চালিয়ে যা ওদের সঙ্গে। আমি পেছনে তোক রাখব। তা ছাড়া মহিষাদলেও পুলিশকে খবর দিয়ে রেখেছি।
এমন কি পাঁশকুড়ো লোকালে, ঠিক আমাদের পাশের কামরায় বসে বৈরাগী-বৈরাগী চেহারায় যে-ভদ্রলোক মধ্যে-মধ্যে ট্রেনের বাইরে গলা বাড়িয়ে গেয়ে উঠছিলেন : হরিনাম বলো রে, নিতাই-গৌর ভজো রে—তিনি নাকি আমাদের ওয়াচ করছিলেন। চন্দ্র নিকেতন পর্যন্ত দূর থেকে আমাদের ফলো করেছিলেন এবং চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের ঘরে যখন টেনিদা খগেন মাশ্চটককে কীচক বধ করে ফেলেছে, তখন তিনিই থানা থেকে পুলিশ নিয়ে চলে এসেছিলেন।
পুলিশের লোকেরা ওদের তো দলটল সুদ্ধ ধরে ফেলল, তারপর চন্দ্ৰকান্তের বাড়ি থেকে অনেক রকম কী সব লুকনো জিনিস-টিনিসও পেল; আর আমাদের কী বলল? সে-সব শুনলে তোমাদের হিংসে হবে। আমরা তো লজ্জায় কান-টান লাল করে দাঁড়িয়ে রইলুম। আর পুলিশের দারোগা টেনিদার হাত-টাত ঝাঁকিয়ে বললেন, তুমি তো দেখছি ছোকরা রীতিমতো গ্রেটম্যান। অত বড় একটা তিন মনী জোয়ানকে তক্তাপাট করে দিলে—অ্যাাঁ। তোমরাই হচ্ছ দেশের গৌরব—তোমাদের মতো ছেলেই এখন দরকার।
শুনে, টেনিদার মৈনাকের মতো উঁচু নাকটা বিনয়ে কীরকম যেন ছোট একটা সিঙাড়ার মতো হয়ে গেল। আমার কানে কানে বললে, জানিস প্যালা-খগেন মাশ্চটককে জুডোর প্যাঁচ কষিয়ে কীরকম খিদে পেয়ে গেল। পেটের ভেতরে ছুঁই ছুঁই করছে।
আমি অবাক হয়ে বললুম, খিদে পেল? এখুনি খেয়ে—
দারোগা শুনতে পেলেন। আমাকে আর কথাই বলতে দিলেন না। বললেন, খিদে পেয়েছে? বিলক্ষণ! এই রামভজন, জলদি রসগোল্লা-সন্দেশ-মোতিচুর-সিঙাড়া–বাজারসে যা মিলেগা-ঝুড়ি ভর্তি করকে লে আও।
সবই তো হল। চোরাকারবারীরা তো রা পড়ল—অবকাশঞ্জিনী আর বিক্রমসিংহ ওদের সঙ্গে হাজতে গেল কি না কে জানে! কিন্তু আসল গণ্ডগোল রয়েই গেল।
কম্বল এখনও নিরুদ্দেশ। তার টিকিরও তো খবর পাওয়া গেল না। সে কি সত্যি সত্যিই চাঁদে চলে গেল নাকি? ওর কাকা তোতা বলেছিলেন-কম্বলের চাঁদে চলে যাওয়ার একটা ন্যাক আছে!
আমরা চোরাকারবারী ধরতে চাইনি, কম্বলকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। তার পাত্তাই পাওয়া গেল না। তার মানে, আমাদের অভিযান এ-যাত্রা ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন আমরা কী বলব বদ্রীবাবুকে? কী করে মুখ দেখাব তাঁর কাছে?
চাটুজ্যেদের রকে বসে আমি, টেনিদা আর হাবুল এই নিয়ে গবেষণা করছিলুম। তা হলে কি আবার নতুন করে খোঁজা আরম্ভ করতে হবে? একটা ক্লু-টুলু তো চাই।
টেনিদা দাঁত কিড়মিড় করে বললে, পেতেই হবে হতচ্ছাড়াকে! তারপরে যদি কম্বলকে পিটিয়ে কাটে না বানিয়েছি, তা হলে আমার নাম টেনি শর্মাই নয়।
হাবুল বললে, ছাড়ান দাও—ছাড়ান দাও। অমন পোলার নিরুদ্দেশ থাকনই ভালো। পোলা তো না—য্যান অ্যাঁকখান ভাউয়া ব্যাং।
টেনিদা হাবুলের দিকে তাকাল : ভাউয়া ব্যাং কাকে বলে?
-ভাউয়া ব্যাং কয় ভাউয়া ব্যাংরে।
–শাটাপ!–বিচ্ছিরি মুখ করে টেনিদা বললে, ইদিকে নানান ভাবনায় মরে যাচ্ছি, এর মধ্যে উনি আবার এলেন মস্করা করতে। ফের যদি কুরুবকের মতো বকবক করবি, তা হলে এক থাপ্পড়ে তোর গাল—
আমি জুড়ে দিলুম :গালুডিতে উড়িয়ে দেব।
–বাঃ—এটা তো বেশ নতুন রকম বলেছিস! বিরক্ত হতে গিয়েও টেনিদা খুশি হয়ে উঠল : এর আগে তো কখনও শুনিনি।
— হুঁ হুঁ, আমি সব সময়েই ওরিজিন্যাল—মাথা নেড়ে বললুম।
—ওরিজিন্যাল তুই তো হবিই। তোর লম্বা লম্বা কান দুইখান দ্যাখলেই সেইডা বোঝন যায় হাবুল ফোড়ন কাটল।
ওফ্! টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : আমি মরছি নিজের জ্বালায় এগুলো বাজে বকুনিতে তো পাগল করে দিলে। এখন ওই কম্বলটাকে—বলতে আমাদের পেছনে আর একটা রাম চিৎকার!