টেনিদা এবার টুকুস করে আমার চাঁদিতে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে।
ওফ্—এই কুকুরটার মুখ তো কিছুতেই বন্ধ হয় না। আমরা ভিখিরি, না রিকশাওলা, না দাঁড়কাক, না ওঁর ঝি-চাকর? যাচ্ছি উবগার করতে, ভদ্রলোক আমাদের তেড়ে আসবেন? কী যে বলিস তার ঠিক নেই। পাগল, না পেট খারাপ?
প্যাটই খারাপ—হাবুল মাথা নেড়ে বললে, চিরকালটাই দেখতাছি প্যাট নিয়েই প্যালার যত ন্যাটা।
টেনিদা বললে, চুলায় যাক ওর পেট। এখানে বসে আর গুলতানি করে দরকার নেই–নাউ টু অ্যাঁকশন। চলো এবার বদ্রীবাবুর কাছেই যাওয়া যাক।
আমরা কেন এসেছি, বদ্রীবাবু সেকথা শুনলেন। প্যাঁচার মতো গম্ভীর মুখে মুড়ির বাটিটা একটু-একটু করে সাবাড় করলেন, শেষে আধখানা কাঁচা লঙ্কা কচমচ করে চিবিয়ে খেলেন। তারপর কোঁচায় মুখ মুছে বললেন, হুঁ।
টেনিদা বললে, কম্বলকে খোঁজবার জন্যে আপনি কী করছেন?
বদ্রীবাবু খ্যারখেরে মোটা গলায় বললেন, আমি আবার কী করব? কীইবা করার আছে আমার?
হাবুল বললে, হাজার হোক, পোলা তো আপনার ভাইপো—
নিশ্চয়।–বদ্রীবাবু মাথা নাড়লেন : আমার মা-বাপ মরা একমাত্র ভাইপো, আমারও কোনও ছেলেপুলে নেই। আমার প্রেস, পয়সাকড়ি–সবই সে পাবে।
তবু আপনি তাকে খুঁজবেন না?—টেনিদা জানতে চাইল।
কী করে খুঁজব?–বদ্রীবাবু হাই তুললেন।
কেন, কাগজে বিজ্ঞাপন তো দিতে পারেন।
কী লিখব? বাবা কম্বল, ফিরিয়া আইস? তোমার খুড়িমা তোমার জন্য মৃত্যুশয্যায়? ঠিকানা দাও—টাকা পাঠাইব? সে অত্যন্ত ঘোড়েল ছেলে। ঠিকানা দেবে, আমি টাকা পাঠাব—টাকাও সে নেবে, কিন্তু বাড়ি ফিরবে না।
কেন ফিরবে না?—আমি জিজ্ঞেস করলুম।
তার কারণ–বদ্রীবাবু একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁতের গোড়া খুঁটতে খুঁটতে বললেন, দু-দুবার ক্লাস সেভেনে ফেল করায় আমি তার জন্যে যে-মাস্টার এনেছি, সে নামকরা কুস্তিগির। তার হাতের একটা রদ্দা খেলে হাতি পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে যায়। কম্বল স্বেচ্ছায় আসবে না। মাস্টার নিরুদ্দেশ না হলে তার উদ্দেশ মিলবে বলে আমার মনে হয় না।
আপনে থানায় খবর দিলেন না ক্যান?–হাবুল বললে, তারা ঠিক–
থানা?–বদ্রীবাবু একটা বুক-ভাঙা নিঃশ্বাস ফেললেন : মাস দুই আগে আমার প্রেসের কিছু টাইপ চুরি হয়ে গিয়েছিল, আমি থানায় গিয়েছিলুম। সঙ্গে ছিল কম্বল। দারোগা এজাহার নিচ্ছিলেন, টেবিলের তলায় তাঁর পেয়ারের কুকুরটা ঘুমুচ্ছিল। কম্বল নিচু হয়ে কী করছিল কে জানে, কিন্তু হঠাৎ একটা বিটকেল কাণ্ড ঘটে গেল। বিকট সুরে ঘ্যাও-ঘ্যাও আওয়াজ ছেড়ে কুকুরটা একলাফে টেবিলে উঠে পড়ল, আর এক লাফে চড়ল একটা আলমারির মাথায়, সেখান থেকে একরাশ ধুলোভরা ফাইল নিয়ে নীচে আছড়ে পড়ে গেল। একজন পুলিশ তাকে ধরতে যাচ্ছিল–ঘোয়ঙ বলে তাকে কামড়ে দিয়ে ঘাঁকে ঘ্যাঁকা বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে দরজা দিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে গেল কুকুরটা। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। এজাহার চুলোয় গেল, থানায় হুলুস্থুল কাণ্ড—পাকড়ো পাকড়ো বলে দারোগা কুকুরের পেছনে ছুটলেন। কী হয়েছিল জানো?
বদ্রীবাবু একটু থেমে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। ক্যাবলা বললে, কী হয়েছিল?
কম্বল পকেটে হোমিওপ্যাথিক শিশিতে ভর্তি করে লাল পিঁপড়ে নিয়ে গিয়েছিল আর সেগুলো ঢেলে দিয়েছিল কুকুরটাকে কানে। দারোগা কম্বলকে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় দিয়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তাকে কিংবা আমাকে থানার কাছাকাছি দেখলেও পুরোপুরি সাতদিন হাজতে পুরে রেখে দেবেন।
টেনিদা বললে, আপনার কী দোষ? আপনি তো আর কুকুরের কানে পিঁপড়ে দেননি। কিন্তু দারোগার ধারণা, মন্ত্রটা আমিই দিয়েছি কম্বলের কানে। অভিভাবকের কাছ থেকেই। তো ছেলেমেয়ে শিক্ষা পায়।
না, তা হলে আপনার থানার যাবার পথ বন্ধ—টেনিদা মাথা নাড়ল, আচ্ছা, আমরা যদি আপনার হয়ে—
বাধা দিয়ে বদ্রীবাবু বললেন, কিছু করতে হবে না। আমি জানি, কম্বলকে আর পাওয়া যাবে না। সে যেখানে গেছে, সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না।
কী সর্বনাশ!–আমি আঁতকে বললুম, মারা গেছে নাকি?
মারা যাওয়ার পাত্র সে নয়।বদ্রীবাবু কান থেকে একটা বিড়ি নামিয়ে ফস করে সেটা ধরালেন : সে গেছে দূরে বহু দূরে।
হাবুল বললে, কই গেছে? দিল্লি?
দিল্লি!–বদ্রীবাবু বললেন, ফুঃ।
তবে কোথায়?—টেনিদা বললে, বিলেতে? আফ্রিকায়?
এক মুখ বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে বদ্রীবাবু বললেন, না, আরও দূরে। ছেলেবেলা থেকেই তার সেখানে যাওয়ার ন্যাক ছিল। সে গেছে চাঁদে।
কী বললেন?—চারজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম আমরা।
বললুম–কম্বল চাঁদে গেছে—এই বলে বদ্রীবাবু আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা মুখের ওপর একরাশ বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন।
০২. বদ্রীবাবুর কথা শুনে
আমরা চারজন বদ্রীবাবুর কথা শুনে পরোটার মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলুম, আর টেনিদার উঁচু নাকটা ঠিক একটা ডিম-ভাজার মতো হয়ে গেল। বদ্রীবাবু আমাদের ঠাট্টা করছেন কি না বুঝতে পারলুম না। কিন্তু অমন হাঁড়ির মতো যাঁর মুখ আর বিতিকিচ্ছিরি তিরিক্ষি যাঁর মেজাজ—এই ঝুপসি প্রেসটার ভেতরে একটা হুতোম প্যাঁচার মতো বসে বসে আর কচর মচর করে করে মুড়ি চিবুতে চিবুতে তিনি আমাদের ঠাট্টা করবেন, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হল না।
ঠিক সেই সময় প্রেসের দিকে, বদ্রীবাবুর রান্নাঘর থেকে কড়া রসুন আর লঙ্কার ঝাঁঝের সঙ্গে উৎকট গন্ধ ভেসে এল একটা, খুব সম্ভব শুঁটকী মাছ। সেগন্ধ এমনি জাঁদরেল যে আমরা চার জন্যেই এক সঙ্গে লাফিয়ে উঠলুম—আমাদের ঘোর কেটে গেল।