আমি বললুম, ক্যাবলা—এরা—
ক্যাবলা কেবল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললে, চুপ।
এর মধ্যেই দেখলুম টেনিদা হাবুলের প্লেটের থেকে কী একটা খপ করে তুলে নিলে। আর তুলেই গালে পুরল। হাবুল চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কী যেন বলতেও চাইল, সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথায় বাঁ-হাত দিয়ে ছোট্ট একটা গাঁট্টা মারল টেনিদা।
-যা-যা, ছেলেমানুষের বেশি খেতে নেই। অসুখ করে।
একটা শান্তিভঙ্গ ঘটতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল বিবেন। আর পেছনে যিনি ঢুকলেন–.
বলবার দরকার ছিল না, তিনি কে। তাঁর নাকের দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারলুম। আমাদের টেনিদার নাক চেয়ে দেখবার মতো আমরা সেটাকে মৈনাক বলে থাকি, কিন্তু এর নাকের সামনে কে দাঁড়ায়। প্রায় আধ-হাতটা লম্বা হবে মনে হল আমার—এনাক দিয়ে দস্তুরমতো লোককে গুঁতিয়ে দেওয়া চলে।
আধবুড়ো লোকটা চকচকে টাক আর কাঁচা পাকা গোঁফ নিয়ে এক গাল হাসল। সে-হাসিতে নাকটা পর্যন্ত জ্বলজ্বল করে উঠল তার। বললে, দাদাবাবুরা দয়া করে আমার বাড়িতে এয়েচেন, বড় আনন্দ হল আমার। অধমের নাম হচ্ছে চন্দ্রকান্ত চাঁই—এঁরা আদর করে আমায় নাকেশ্বর বলেন।
টেনিদা আবার কী-একটা হাবুলের প্লেট থেকে তুলে নিয়ে গালে চালান করল। তারপর ভরাট-মুখে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদেরও ভারি আনন্দ হল।
চন্দ্রকান্ত ফরাসে বসে পড়ে বললে, অল্প বয়সেই আপনারা ব্যবসা বাণিজ্যে মন। দিয়েছেন। এ ভারি সুখের কথা। দিনকাল তো দেখতেই পাচ্ছেন। চাকরিবাকরিতে আর কিছু নেই, একেবারে সব ফক্কা! এখন এই সব করেই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমাদের বিটকেলানন্দ গুরুজী সেই জন্যেই আমাদের মন্তর দিয়েছেন : ধনধাত্রী মা নেংটীশ্বরী, তোমারই ল্যাজ পাকড়ে ধরি।—আহা।
শুনেই বিবেনের চোখ বুজে এল। সেও বললে, আহা-হ্।
চন্দ্রকান্ত বলে চলল, মা নেংটীশ্বরীর অপার দয়া যে আপনারা এই বয়েসেই মার ল্যাজে আশ্রয় পেলেন। জয় মা।
বিন্দেবনও সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল : জয় মা। তাই দেখে আমরা চারজনও বললুম, জয় মা!
আমরা তিনজন ভালোই খেয়ে নিয়েছিলুম এর ভেতর, কেবল হাবুল সেন হাঁড়ির মত মুখ করে বসে ছিল।
টেনিদা খেয়ে-দেয়ে খুশি হয়ে বললে, আপনাদের এখানে তো বেশ ভালোই মিঠাই পাওয়া যায় দেখছি। মানে, কলকাতায় আমরা তো বিশেষ পাই-টাই না—মানে ছানা-টানা বন্ধ–
চন্দ্রকান্ত বললে, বিলক্ষণ। আমাদের এখানকার মিষ্টি তো নামকরা। আরও কিছু আনাব?
টেনিদা ভদ্রতা করে বললে, নামানে, ইয়ে—এই হাবুল একটা চমচম খেতে চাইছিল
—নিশ্চয়-নিশ্চয়, চন্দ্রকান্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে ডাকল, ওরে বিধু, আরও কটা চমচম নিয়ে আয়। আরও কিছু এনো।
চন্দরদা, এত আদর করে খাওয়াচ্ছ কাকে?বাজখাঁই গলায় সাড়া দিয়ে আর একটি লোক ঘরে ঢুকল। হাতকাটা গেঞ্জির নীচে তার চুয়াল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, ড়ুমো ড়ুমো হাতের মাল্ল, ছাঁটা ছাঁটা ছোট চুল, করমচার মতো টকটকে লাল তার চোখের দৃষ্টি।
চন্দ্রকান্ত বললে, এঁরা কলকাতা থেকে এয়েচেন—ছড়া বলেচেন—আমাদের হেড আপিসে গিয়েছেন
সেই প্রকাণ্ড জোয়ান লোকটা হঠাৎ ঘর ফাটিয়ে একটা হুঙ্কার করল। বললে, চন্দরদা, সর্বনাশ হয়েছে। এরা শত্রু।
আমরা যত চমকালুম, তার চাইতেও বেশি চমকাল চন্দ্রকান্ত আর বিবেন!–শত্রু।
আলবাত।—দাঁতে দাঁতে কিশ কিশ করতে করতে একটা রাক্ষসের মতো আমাদের। দিকে এগিয়ে আসতে লাগল জোয়ানটা : আমি খগেন মাশ্চটক—আমার সঙ্গে চালাকি। এরা সেই পটলডাঙার চারজন—চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে থাকে, আমার সেই বিচ্ছু ছাত্র কম্বলকে এদের পিছে পিছেই আমি ঘুরঘুর করতে দেখেছি। করমচার মতো চোখ দুটোকে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে খগেন মাশ্চটক বললে, এত বড় এদের সাহস যে আজ একেবারে বাঘের গর্তে এসে মাথা গলিয়েছে। আজ যদি আমি এদের পিটিয়ে মোগলাই পরোটা না করে দিই, তা হলে আমি মিথ্যেই স্বামী বিটকেলানন্দের চ্যালা?
১০. টেনিদার ভাষায় বলা—পুঁদিচ্চেরি
একেই বলে আসল পরিস্থিতি—টেনিদার ভাষায় বলা—পুঁদিচ্চেরি।
ঘরের ভিতরে বাজ পড়েছে—এই রকম মনে হল। চন্দ্রকান্ত আর বিন্দেবন হাউমাউ করে উঠল, আমরা চারজন একেবারে চারটে জিবেগজার মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলুম। আর পাকা করমচার মতো খুদে-খুদে লাল চোখ দুটোকে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে খ্যাপা মোষের মতো চেঁচাতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর জোয়ান খগেন মাশ্চটক।
আর এতক্ষণে আমার মনে হল, এই মোষের মতো খগেনটা আছে বলেই জায়গাটার বোধহয় নাম হয়েছে মহিষাদল। সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ল, আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার সময়, কেন যেন খামকাই আমার বাঁ কানটা কটকট করছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল, আজ একটা যাচ্ছেতাই রকমের কিছু ঘটে যাবে।
আমরা পটলডাঙার চারজন বিপদে পড়লে কি আর ভয়-টয় পাই না? আমি যখন আগে ছোট ছিলুম, পেট-ভর্তি পিলে নিয়ে প্রায় জ্বরে পড়তুম, তখন, রাত্তিরে জানালার বাইরে একটা হুতুম প্যাঁচা হুমহাম করে ডেকে উঠলেও, ভয়ে আমার দম আটকে যেত। তারপর বড় হলুম, দু-একটা ছোটখাটো অ্যাঁডভেঞ্চার জুটে গেল বরাতে। তখন দেখতে পেলুম, বিপদে ঘাবড়ে যাবার মতো বেকুবি আর কিছু নেই। তাতে বিপদ কমে না বরং বেড়েই যায়। তার চাইতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হয়, এখন কী করা যায় কী করলে সব চাইতে ভালো হয়। তা ছাড়া আরও দেখেছি-যারা আগ বাড়িয়ে ভয় দেখাতে আসে, তারা নিজেরাই মনে মনে ভীরু। পিঠে সোজা করে, বুক টান করে, মনে জোর নিয়ে রুখে দাঁড়ালে তারাই অনেক সময় পালাতে পথ পায় না।