রিকশা বেশ ঠনুতুন করে নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছিল। দু-দিকে বাড়ি-টাড়ি আছে, গাছপালা, মাঠ এইসব আছে, ভারি সুন্দর হাওয়া দিয়েছে, আকাশটা যেন নীল চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে, এদিকে আবার একটা খালের জল রোদে ঝিলমিল করে উঠছে। বিদ্বেনের মনে ফুর্তি হতেই পারে, কিন্তু তাই বলে
আমি আর থাকতে পারলুম না। ক্যাবলাকে জিজ্ঞেস করলুম, চামচিকের গান শুনেছিস কখনও?
ক্যাবলা বললে, না।
তা হলে ওই শোন। বিবেন গান গাইছে।
ক্যাবলা বললে, চামচিকে তো তবু ভালো। তুই গান গোিল তো মনে হয় যেন হাঁড়িচাঁচা ডাকছে। এখন আর ইয়ার্কি করিসনে প্যালা—অবস্থা খুব সঙ্গিন। আমরা দারুণ বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি।
দারুণ বিপদ! শুনেই আমি খাবি খেলুম। বিবেনের গান শুনে, সবুজ, মাঠ, নীল আকাশ আর ঝিরঝিরে হাওয়ার ভেতরে মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল, কিন্তু ক্যাবলা আমাকে এমন দমিয়ে দিলে যে বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করতে লাগল।
চিঁ চিঁ করে বললুম, কী বিপদ?
একটু পরেই জানতে পারবি।
তা হলে আমরা রিকশা চেপে কেন যাচ্ছি বিন্দেবনের সঙ্গে? নেমে পড়ে সোজা চম্পট দিলেই তো পারি। ইচ্ছে করে কেন পা বাড়াচ্ছি বিপদের ভেতর?
ক্যাবলা আরও গম্ভীর ভাবে বললে, আর ফেরবার পথ নেই। এখন একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।
আমি বললুম, কিন্তু ওসপার করে কী লাভ? এসপারে থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
—তা যায় কিন্তু কম্বলকে তা হলে পাওয়া যাবে কী করে?
ঠিক কথা। ওই লক্ষ্মীছাড়া কম্বল। যত গণ্ডগোল ওকে নিয়েই। মাস্টারের ভয়ে পালালি তো পালালি—আবার বিটকেল একটা ছড়া লিখে গেলি কী জন্যে? চাঁদে গেছে না হাতি। সেই-যে কারা সব নরমাংস খায়, তাদের ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছে, আর তারা কম্বলকে দিয়ে অম্বল বেঁধে খেয়ে বসে আছে।
কিন্তু কম্বলকে কি কেউ খেয়ে হজম করতে পারবে? আমার সন্দেহ হল। ও ঠিক বাতাপি কিংবা ইম্বলের মতো তাদের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। যেদিন কম্বল কোত্থেকে দুটো গুবরে পোকা এনে আমার শার্টের পকেটে ছেড়ে দিয়েছিল, সেদিন থেকেই ওকে আমি চিনে গেছি।
এই সব ভাবছি, হঠাৎ ক্যাবলা আমার কানে কানে বললে, প্যালা!
আমি দারুণ চমকে গিয়ে বললুম, আবার কী হল?
—এই যে খালের ধার দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এ দেখে কিছু মনে হচ্ছে না তো?
—কী আবার মনে হবে?
ক্যাবলা আরও ফিসফিস করে বললে, আভিতক তুম্ নেহি সমঝা? আরে, সেই যে ছড়াটা, ছল ছল খালের জল—
ঠিক ঠিক। নিরাকার মোষের দল—মানে মোষ-টোষ বিশেষ কিছু নেই অথচ মহিষাদল আছে, আর দেখাতেই ছল ছল—আরে অক্ষরে-অক্ষরেই মিলে যাচ্ছে যে!
ক্যাবলা মিটমিট করে হেসে বললে– কী বুঝছিস?
—কিছুই না।
—তোর মাথা তো মাথা নয়, যেন একটা খাজা কাঁটাল। চশমাপরা নাকটাকে কুঁচকে, মুখখানাকে স্রেফ আমড়ার চাটনির মতো করে ক্যাবলা বললে, এটাও বুঝতে পারছিস না? এবার রহস্য প্রায় ভেদ হয়ে এল।
—কিন্তু ভেদ করবার পরে আমাদের অবস্থা কী হবে? আমাদের সুদ্ধ ভেদ করে দেবে না তো?
—দেখাই যাক। আগেই ঘাবড়াচ্ছিস কেন?
বলতে বলতে রিকশা থেমে গেল। সামনেই একটা হলদে দোতলা বাড়ি। তার নাম লেখা আছে বড় বড় হরফে : চন্দ্র নিকেতন।
রিকশা থেকে নেমে বিনে ডাকতে লাগল : আসুন দাদাবাবুরা, নেমে আসুন। এই বাড়ি।
ক্যাবলা আবার আমার কানে কানে বললে, এইবারে শেষ খেলবুঝেছিস? বাড়ির নাম চন্দ্র নিকেতন—অর্থাৎ কিনা—চাঁদে চড়-চাঁদে চড়। এইটেই তা হলে শ্রীকম্বলের সেই চাঁদ।
-কম্বলের চাঁদ! এইখানে?—আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না।
ক্যাবলা বললে, বোকার মতো বসে আছিস কী? টেনিদা, হাবলা আর বিবেন যে ভেতরে চলে গেল। নেবে আয়—নেবে আয়–
ওদিক থেকে বিন্দেবনের হাঁক শোনা গেল : অ রিকশোওলারা—একটু পেঁইড়ে যাও, আমি এক্ষুনি তোমাদের পয়সা এনে দিচ্চি।
বিন্দেবন একটা মস্ত ঘরের ভেতর আমাদের নিয়ে বসাল।
ঘরের আধখানা জুড়ে ফরাস পাতা—তার ওপর শাদা চাদর বিছানো। বাকি আধখানায় মস্ত একটা দাঁড়িপাল্লা আর কতগুলো কিসের বস্তা যেন সাজানো রয়েছে। একটা ছোট্ট কুলুঙ্গিতে সিঁদুর-মাখানো গণেশের মূর্তি। দেওয়ালে একটা রঙিন ক্যালেন্ডার রয়েছে তাতে লেখা আছে বিখ্যাত মশলার দোকান শ্রীরামধন খাঁড়া, খড়গপুর বাজার, মেদিনীপুর। দেওয়ালে আবার দুতিন জায়গায় সিঁদুর দিয়ে লেখা রয়েছে জয় মা। মা যে কে ঠিক বুঝতে পারলুম না, বোধ হল নেংটীশ্বরীই হবেন। কিন্তু এসব জয় মা আর খাঁড়া টাঁড়া আমার একদম ভালো লাগল না, বুকের ভেতরটায় কী রকম ছাঁৎ করে উঠল, একেবারে পাঁঠাবলির কথা মনে পড়ে গেল।
আমরা চারজনে বসে আছি। ক্যাবলা গম্ভীর, টেনিদা, মিটমিট করে তাকাচ্ছে। এদিক-ওদিক, হাবুল এক মনে পা চুলকোচ্ছে—বোধহয় ট্রেনের ছারপোকাগুলো ঢুকে আছে। ওর জামাকাপড়ের তলায়। আমি ভাবছি, ওই খাঁড়া-টাড়া দিয়ে ওরা জয় মা বলে কম্বলকে বলি দিয়েছে কি না, এমন সময়–
দুজন লোক ঘরে এল। বেশ ভালো মানুষের মতোই তাদের চেহারা, তার চাইতেও ভালো তাদের হাতের প্লেট নামিয়ে দিয়ে বলা, একটু জলযোগ করুন বাবুরা, কত্তা এখনি আসছেন।
মেচেদার সিঙাড়া এর মধ্যেই যখন তলিয়ে গিয়েছিল, আমরা খুশি হয়েই কাজে লেগে গেলুম। প্লেটে তিন-চার রকমের মিষ্টি, কাজু বাদাম, কলা। মোতিচুরের লাড়ুতে কামড় দিয়েই আবার আমার মনটা ছটফটিয়ে উঠল। বলির পাঁঠাকেও তো বেশ করে কাঁটাল পাতা-টাতা খাওয়ায়। এরাও কি–