কী খাওয়া যে কপালে আছে—সে শুধু আমিই বুঝতে পারছি। কিন্তু বেঁচে থাকতে কাওয়ার্ড হওয়া যায় না—না হয় মোষের তোতেই প্রাণ দেব। আমি কেবল বললুম, আচ্ছা—আচ্ছা।
-আচ্ছা-আচ্ছা কী? যদি পেটের গোলমাল হয়, তা হলে তোকে ধরে আটটা ইজেকশন দেব—সে কথা খেয়াল থাকে যেন।
বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ার সবচাইতে অসুবিধে এই যে, কোথাও কোনও সিমপ্যাথি পাওয়া যায় না। এমনি ভালোমানুষ ছোটদি পর্যন্ত খ্যাখ্যা করে হাসছিল। আমি চটে-মটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। এই সব অপমান সহ্য করার চাইতে মৃত্যুও ভালো।
পাঁশকুড়া লোক্যালে চেপে আমরা রওনা হয়েছি হাওড়া থেকে। বিন্দেবন বললে, আমাদের নামতে হবে মেচেদায়, সেখান থেকে বাসে করে তমলুক হয়ে মহিষাদল। শুনে যতদূর মনে হচ্ছে তা নয়—যেতে বেশি সময় লাগবে না।
কিন্তু মেচেদা নাম শুনেই আমার কী-একটা ভীষণভাবে মনে পড়ছিল। একবার মামার সঙ্গে মেদিনীপুরে যাওয়ার সময়—এই মেচেদাতে—ঠিক ঠিক!
আমি বলে ফেললুম, খুব ভালো সিঙাড়া পাওয়া যায় কিন্তু!
টেনিদার চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু বিন্দেবনের সামনে প্রেস্টিজ রাখবার জন্যেই বোধহয়, দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে ধমক দিলে একটা : এটা একটা রাক্ষস। রাতদিন কেবল খাই-খাই।
বিন্দেবনকে যতটা খারাপ লোক ভেবেছিলুম, দেখলুম সে তা নয়। মিটমিট করে বললে, তা ছেলেমানুষ, খিদে তো পেতেই পারে। খাওয়াব খোকাবাবু—মেচেদার সিঙাড়া খাওয়াব, কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না! তারপর কলেজের ছেলে হয়েও তোমরা যখন আমাদের দলে এয়েছ, তখন তো মাথার মণি করে রাখব তোমাদের।
দলে এয়েচ! এই কথাটাই আমার কেমন ভালো লাগল না। মনে পড়ল মা নেংটীশ্বরীর সেই মূর্তি—যেন দাঁত বের করে কামড়াতে আসছে। মনে পড়ল, হঠাৎ সেই ম্যাও-ম্যাও এসে হাজির—চারিদিকে কী রকম সামাল-সামাল রব। এদের পাল্লায় পড়ে কোথায় চলেছি আমরা? কী আছে আমাদের কপালে?
টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম। হাঁড়ির মতো মুখ করে বসে রয়েছে। বীরচক্র পাবার জন্যে তখন খুব লাফালাফি করছিল বটে, কিন্তু এখন যেন কেমন ভেবড়ে গেছে বলে মনে হল। হাবুলকে বোধহয় গাড়ির বেঞ্চিতে ছারপোকায় কামড়াচ্ছিল—সেই বিক্রমসিংহই কি না কে জানে—সে কিছুক্ষণ পা-টা চুলকে হঠাৎ বিচ্ছিরি গলায় গান ধরল :
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি-সকল দেশের রানী–ইয়ে একবার খুব জোরে গা চুলকে প্রায় দাপিয়ে উঠল : ইস্ কী কামড়াইতেছে রে! সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি–
তার গান আর গা চুলকোনোতে প্রায় খেপে গেল টেনিদা। চেঁচিয়ে বললে, জন্মভূমি না তোর মুণ্ডু! চুপ কর বলছি হাবলা, নইলে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেব তোকে।
বিন্দেবন বললে, আহা দাদাবাবু তো ভালোই গাইছেন! থামিয়ে দিচ্ছেন কেন?
তা হলে হাবুলের গানও কারও ভালো লাগে! হাবুল এত আশ্চর্য হল যে, গা চুলকোতে পর্যন্ত ভুলে গেল। ক্যাবলা একটা ওয়াইড ওয়ার্লর্ড ম্যাগাজিন পড়ছিল, সেটা খসে পড়ল তার হাত থেকে। টেনিদা বললে, কী ভয়ানক!
বিন্দেবন জানলার বাহিরে মুখ বাড়িয়ে বললে, এই যে, কোলাঘাট এসে গিয়েছে। এর পরেই আমরা পৌঁছে যাব মেচেদায়।
০৯. মেচেদার সিঙাড়া-টিঙাড়া খেয়ে
মেচেদার সিঙাড়া-টিঙাড়া খেয়ে, সেখান থেকে বাসে করে তমলুক পৌঁছনো গেল। সেখান থেকে আবার বাস বদলে মহিষাদলে।
নাম শুনে যেরকম ভয়-টয় ধরে যায়, গিয়ে দেখলুম আদৌ সেরকম নয়। বরং বেশ ছিমছাম জায়গাটা—দেখে-টেখে ভালোই লাগে। খুব বড় একটা রাজার বাড়ি আছে, একটা উঁচু রথ আছে, বাজার আছে, অনেক লোকজন আছে। মানুষগুলোকেও তো বেশ সাদা-মাটা মনে হল, কোথাও যে কোনও ঘোর-প্যাঁচ আছে সেটা বোঝা গেল না। আর একটা মোটে মোষ দেখতে পেলুম, একজন তার গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল, সুড়সুড় করে চলে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে সে মোটেই তোতে চাইল না।
বিন্দেবন তিনটে রিকশা ডাকল। বললে, তা হলে চলুন, একেবারে মালখানাতেই যাওয়া যাক।
টেনিদা বললে, মালখানা? সে আবার কোথায়?
বিন্দেবন বললে, দেখা নেই তো সব। চন্দ্রকান্তদার সঙ্গে সেখানেই দেখা হবে। তিনি মালপত্তর সব দেখিয়ে দেবেন। তারপর কলকাতায় কোথায় আপনারা ডেলিভারি নেবেন, সেসবও ওখানেই ঠিক হয়ে যাবে।
মালপত্তর! আমি আর ক্যাবলা একটা রিকশায় চেপে বসেছিলুম। মালপত্তর শুনেই আমার কীরকম যেন বিচ্ছিরি লাগল, সেই শেয়ালপুকুরের কথা মনে পড়ে গেল, মনে পড়ল সেই ম্যাও ম্যাও আসবার কথা, আমি ক্যাবলাকে চিমটি কাটলুম একটা।
ক্যাবলা আমাকে পালটা এমন আর-একটি চিমটি কাটল যে আমি প্রায় চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে সামলে নিলুম। ক্যাবলা আমার কানে কানে বললে, এখন চুপ করে থাক না—গাধা কোথাকার।
চিমটি আর গাধা শব্দ এ-অবস্থাতে আমাকে হজম করে নিতে হল কী আর কথা! সব ব্যাপারটাই এখন এমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে যে আমি গাধার মতোই চুপ করে বসে রইলুম। অবিশ্যি গাধা যে সব সময়ে চুপচাপ বসে থাকে তা নয়—মনে একটু ফুরতি টুরতি হলেই বেশ দরাজ গলায় প্যাঁহোঁ হ্যাঁ হে বলে তারস্বরে গান গাইতে থাকে। আমার গলায় টান-টান শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু–
কিন্তু কুঁই কুঁই করে কেমন একটা বেয়াড়া গানের আওয়াজ আসছে না? আসছেই তো। তাকিয়ে দেখলুম, সামনের রিকশাতে বসে গান ধরেছে তালঢ্যাঙা বিন্দেবন।
এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো—
এ যে দেখছি গানের একেবারে গন্ধর্ব! আমার চাইতেও সরেস, হাবলার ওপরেও এক কাঠি। এমন ভালো গানটারই বারোটা বাজিয়ে দিলে! তা ছাড়া এমন সকালের রোদ্দুরে চাঁদের আলোই বা পেলে কোত্থেকে! সেই চাঁদের আলোয় বিবেন আবার মরতেও চাইছে। তা নিতান্তই যদি মরতে চায়, তা হলে নয় মারাই যাক, আমরাও ওর জন্যে শোকসভা করতে রাজি আছি, কিন্তু সে-জন্যে অমন চামচিকের মতো গলায় গান গাইবার মানে কী? নিজে এমন গাইয়ে বলেই বোধহয় সে হাবলার গানের তারিফ করছিল।