আমি বললুম, আর বাড়িতে?
—কান ধইরা ছিড়া দিব। পুলিশের পিটুনির থিক্যাও সেটা খারাপ।
আমি বললুম, অনেক খারাপ। তোর হয়তো একটা কান ছিঁড়ে দেবে, কিন্তু মেজদার বরাবর নজর আমার কানের দিকেই। ওর ডাক্তারি কাঁচি দিয়ে কচাকচ করে কেটে নেবে।
হাবুল কিছুক্ষণ ভাবুকের মতো আমার কানের দিকে চেয়ে রইল। শেষে মাথা নেড়ে বললে, তা কাইট্যা নিলে তোরে নেহাত মন্দ দ্যাখাই না। তোর খাড়া খাড়া কান দুইখান
আমি বললুম, শাট আপ! বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে যাবে হাবলা।
হাবুল ফের বললে, আইচ্ছা, মনে যদি কষ্ট পাস, তাইলে ওই সব কথা থাকুক। তোর আদরের কান দুইখ্যান লইয়া তুই ঘাস-ফাস চাবা। তা অখন কী করন যায়, তাই ক।
আমার ইচ্ছে করছিল হাবলাকে একটা চড় বসিয়ে দিই, কিন্তু ভেবে দেখলুম এখন গৃহযুদ্ধের সময় নয়। এই সব ঝামেলা মিটে যাক, তারপর হাবলার সঙ্গে একটা ফয়সালা করা যাবে।
রাগ-টাগ সামলে নিয়ে বললুম, তা হলে চল, ক্যাবলার কাছে যাই। তাকে গিয়ে বলি—যা হয়েছে বেশ হয়েছে। আর দরকার নেই, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের চাঁদবদন না দেখলেও আমাদের চলবে।
হাবুল বললে, হ। দ্যাখনের তো কত কী-ই আছে। ইচ্ছা হইলেই তো চিড়িয়াখানায় গিয়া আমরা জলহস্তীর বদনখান দেইখ্যা আসতে পারি। আর কম্বলরে দিয়াই বা আমাগো কী হইব? পোলা তো না—য্যান, একখানা চামচিকা। চক্ৰধরের অবকাশরঞ্জিনীর থিক্যাও খারাপ।
আমি সায় দিয়ে বললুম, বিক্রমসিংহের চাইতেও খারাপ। সে তো শুধু ছারপোকা, ও একটা কাঁকড়াবিছে।
এই সব ভালো ভালো আলোচনা করে আমরা ক্যাবলার কাছে গেলুম। কিন্তু তাকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। তার মা—মানে মাসিমা ছানার মুড়কি তৈরি করছিলেন, আমাদের বসিয়ে তাই খেতে দিলেন। আমরা ক্যাবলার ওপর রাগ করে এত বেশি খেয়ে নিলুম যে ক্যাবলার জন্যে কিছু রইল বলে মনে হল না।
পেট ঠাণ্ডা হলে মন খুশি হয়, আমরা দুজনে বঙ্গ আমার জননী আমার গাইতে গাইতে যেই টেনিদার বাড়ির কাছে পৌঁছেছি, অমনি কোত্থেকে হাঁ হাঁ করে বেরিয়ে এল টেনিদা।
—বেলা দশটার সময় অমন গাঁক-গাঁক করে চ্যাঁচাচ্ছিস যে দুজনে? ব্যাপার কী? হাবুল বললে, আমারা সঙ্গীত-চর্চা করতে আছিলাম।
—সঙ্গীত-চর্চা? ওকে চচ্চড়ি বলে। তোদের গানের চোটে পাড়ায় আর কুকুর থাকবে মনে হচ্ছে। তা এত আনন্দ কেন? কী হয়েছে?
–আমরা ক্যাবলার বাড়িতে গিয়ে ছানার মুড়কি খেয়ে এসেছি। আমি জানালুম।
—অ, তাই এত ফুর্তি হয়েছে। তা আমাকে ডেকে নিলি না কেন? ক্যাবলাও এমন বিশ্বাসঘাতক?
–ক্যাবলাকে বাড়িতে পাইনি। আর তোমার কথা আমাদের মনে ছিল না।
—মনে ছিল না?-টেনিদা চটে গেল। মুখটাকে বেগুনভাজার মতো করে বলল, ভালো কাজের সময় মনে থাকবে কেন?—যা বেররা এখান থেকে, গেট আউট।
আমি বললুম, আউট আবার কোথায় হব? বেরুবার আর জায়গা কোথায়? আমরা তো রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।
টেনিদার মুখটা এবারে ধোঁকার ডালনার মতো হয়ে গেল। আরও ব্যাজার হয়ে বললে, ইচ্ছে করছে, দুই চড়ে তোদের দাঁতগুলোকে দাঁতনে পাঠিয়ে দিই। তা হলে মর গে যা রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে কুকুর তাড়া গে।
হাবুল বললে, না, কুকুর তাড়ামু না। তোমার কাছে আসছি।
—আমাকে তাড়াতে চাস?
–বালাই, ষাইট। তোমারে তাড়াইব কেডা? তুমি হইলা আমাগো লিডার—যারে কয় ছত্রপতি। তোমার কাছে অ্যাঁকটা নিবেদন আছিল।
—ইস্, ছানার মুড়কি খেয়ে খুব যে ভালো-ভালো কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। টেনিদা একটা ভেংচি কাটল : তা, নিবেদন কী?
আমরা মহিষাদলে যামু না। মইষে গুঁতাইয়া মারব।
যাসনে। বাঘাটে গলায় টেনিদা বললে, লোকের বাড়ি বাড়ি চেয়ে-চিন্তে খেয়ে বেরা। কাপুরুষ কোথাকার। কাওয়ার্ডস মেনি ডেথ ডাইজ—ইয়েটাইম—মানে বিফোর—
আমি বললুম, উঁহু, ভুল হল। কাওয়ার্ডস ডাই মেনি ডেথস—
ছানার মুড়কির রাগ টেনিদা ভুলতে পারছিল না, চিৎকার করে বললে, শাটা! তোকে আর আমার ইংরিজী শুদ্ধ করতে হবে না—নিজে তো একত্রিশের ওপরে নম্বর পাস্ না! মরুক গে, কোথাও যেতে হবে না তোদের। আমি আর ক্যাবলা যাব, একটা দারুণ চক্রান্ত থেকে উদ্ধার করব কম্বলকে, বীরচক্র পুরস্কার পাব আর তোরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবি। কম্বলের কাকা যখন খ্যাঁট দেবে, তখন পোলাওয়ের গন্ধে দরজায় তোরা ঘুরঘুর করবি, ঢুকতে দেবে না, পিটিয়ে তাড়িয়ে দেবে।
এই বলে টেনিদা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল, তারপর ধড়াস করে বন্ধ করে দিল দোরটা।
তখন আমি আর হাবুল সেন এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম। আমি বললুম, বুঝলি হাবল, ব্যাপারটা রীতিমতো সঙ্গিন।
হাবুল বললে, হ। টেনিদা যারে পুঁদিচ্চেরি কয়, তাই। কীরকম য্যান মেফিস্টোফিলিস মেফিস্টোফিলিস মনে হইতাছে।
আমি বললুম, তা হলে তো যেতেই হয়, কী বলিস?
হইবই তো। বীরচক্র আমরাই বা পামু না ক্যান? আর কম্বলের কাকা যখন অগো মাংস-পোলাউ খাওয়াইব–
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, আর বলিসনি, মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দেখিস, আমরাও খাব, নিশ্চয় খাব।
যা থাকে কপালে—পটলডাঙা জিন্দাবাদ! আমরা চারজন—সেই কথামতো-চক্রধরের দোকানের সামনে থেকে, বিন্দেবনের সঙ্গে, মহিষাদলে বেরিয়ে পড়েছি। বাড়িতে বলে এসেছি, রবিবারে এক বন্ধুর ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি, সন্ধেবেলায় ফিরে আসব।
আসবার আগে মেজদা বলে দিয়েছে, পরের বাড়িতে গিয়ে মওকা পেয়ে যা-তা খাসনে। ওই তোর পিলে-পটকা শরীর, শেষকালে একটা কেলেঙ্কেরি বাধাবি।