বললে, খদ্দের? এত ছেলেমানুষ?
টেনিদা বললে, আমরা কলেজে পড়ি। ছেলেমানুষ নই।
তা বটে—তা হলে তো আর ছেলেমানুষ কওয়া যায় না।
বিন্দেবন মাথা নাড়ল : তা ছাড়া ওঁরা ছড়া বলেচেন; চাঁদনিতে তোমার দোকানেও গেছলেন।—বিন্দেবন আমাদের দিকে তাকাল : বুঝছেন তো, ইনিই হচ্ছেন গুরুদেবের প্রধান শিষ্য-পাটকেলানন্দ। একেই বাইরের লোক চক্রধর সামন্ত বলে জানে। বসুন-বসুন আপনারা!
আমরা মাদুরে বসে পড়লুম।
পাটকেলানন্দ ওরফে চক্রধর এবার গম্ভীর হয়ে ঝোল্লা গোঁফে তা দিলে। তারপর খানিকক্ষণ ভাবুক-ভাবুক মুখ করে চোখ বুজে বসে রইল। সে যে আর চক্রধর নয়, একেবারে মূর্তিমান পাটকেলানন্দ, সেইটেই যেন বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল আমাদের। এতক্ষণ যে কম্বলের তলায় পড়ে ক্যাঁক্যাঁ করছিল, এখন আর তা বোঝবারও জো নেই।
বাইরে বাদুড়টা হঠাৎ খ্যাঁচম্যাচে আওয়াজ করে উঠল।
সেই আওয়াজে চক্রধর চোখ খুলল।
ঠিক আছে। অবকাশরঞ্জিনী সাড়া দিয়েছে। ঠিক আছে।
টেনিদা বোকার মতো বললে, মানে?
মানে অবকাশরঞ্জিনীর ভেতরে গুরুদেব যোগশক্তি সঞ্চার করেছেন। ও ক্যাঁচমেচিয়ে উঠলেই আমরা বুঝতে পারি, কোথাও কোনও গোলামাল নেই।
যদি ক্যাঁচম্যাচ না করে?—আমি জানতে চাইলুম।
তা হলে খোঁচা দিতে হয়।
যদি তাও চুপ কইরা থাকে?–হাবুল কৌতুহলী হল।
তখন বুঝতে হবে ব্যাপার খুব সঙ্গিন। তখন তক্তপোশের ফাটল থেকে বিক্ৰমসিংহকে ডাকতে হবে। যাকগে, সে সব অনেক কথা।—চক্রধর বললে, তা হলে আপনারা চারজন?
টেনিদা বললে, হুঁ, চারজন।
কোথায় থাকেন?
—পটলডাঙা।
ছড়া বলুনসঙ্গে সঙ্গে নামতা পড়ার মতো আমরা কোরাসে আরম্ভ করলুম : চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর–
চক্রধর বললে, থাক–থাক, আর দরকার নেই। চন্দ্রকান্তকে ওখানে গিয়েই। পাবেন—মানে মহিষাদলে। এই বিলেবনই আপনাদের নিয়ে যাবে। টাকার রসিদ আছে তো?
টাকার রসিদ! আমি চমকে কী বলতে যাচ্ছিলুম, ক্যাবলা আমাকে একটা খোঁচা মারল। তারপর বললে,আজ্ঞে হ্যাঁ, রসিদ-উসিদ সব আছে। বাড়িতে রেখে এসেছি।
তা হলে আর কী? কবে যাবেন?
ক্যাবলা ফস করে বললে, রবিবার?
সে তো বেশ কথা। আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবেন। ভোর ছটার মধ্যে এলে চটপট চলে যেতে পারবেন, সন্দের মধ্যে ফিরেও আসতে পারবেন। রাজি?
আমরা কিছু বলার আগেই ক্যাবলা বললে, রাজি।
তা হলে এই কথা রইল।—চক্ৰধর আবার ফ্যাঁচ করে বেঁচে উঠল : ইঃ, জব্বর সর্দিটাই লাগল। খামকা ক্যাঁথা কম্বল চাপিয়ে মরুকগে, এখন মা নেংটীশ্বরীকে প্রণাম করে বাড়ি চলে যান। আর রবিবারে ভোর ছটায় আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবেন। ঠিক?
ক্যাবলা বললে, ঠিক।
জয় মা নেংটীশ্বরী—তোমারই ইচ্ছে মা!—চক্রধর শিবনেত্র হয়ে যেন ধ্যানে বসল। তারপর বললে, হাঁ, আর একটা কথা। যাবার আগে অবকাশরঞ্জিনীর ভোগের জন্য সপাঁচ আনা পয়সা রেখে যাবেন মনে করে।
০৮. রবিবার না হয় মহিষাদলেই গেলুম
সে তো হল। রবিবার না হয় মহিষাদলেই গেলুম। কিন্তু তারপর?
সবটাই কী রকম গোলমালে ঠেকছে। হতচ্ছাড়া কম্বলের আগাগোড়াই বিটকেল ব্যাপার। যখন নিরুদেশ হয়নি, তখন পাড়াসুদ্ধ লোকের হাড় ভাজাভাজা করে ফেলছিল; যখন উধাও হল তখনও মাথার ভেতরে বনবনিয়ে কুমোরের চাক ঘুরিয়ে দিলে।
আচ্ছা তোমারই বলল, লোকে কি আর নিরুদ্দেশ হয় না। পরীক্ষায় ফেল-টেল করে ঠেঙানি খাওয়ার ভয়ে কিংবা হয়তো ঠাকুদার কাছ থেকে একটা গিটার আদায় করবার আশায়, কেউ হয়তো বন্ধুর বাড়িতে চম্পট দেয়—আবার কেউ বা মাসি-পিসির বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। তারপর যেই বিজ্ঞাপন বেরুল : প্রিয় ট্যাঁপা, শীঘ্র ফিরিয়া আইস! মা মৃত্যুশয্যায়, তোমাকে কেহ কিছু বলিবে না, কিংবা স্নেহের ন্যাদা, তোমার ঠিকানা দাও—সকলেই কাঁদিতেছে তখন গর্তের থেকে পিঁপড়ের মতো সব সুড়সুড় করে একে-একে বেরিয়ে এল। তারপর রাত বুঝে কারও অদৃষ্টে চাঁটানি, কারও বা হাওয়াইয়ান গিটার!
কিন্তু এই সব ভালো ছেলেদের মতো বুঝেসুঝে নিরুদ্দেশ হবে, কম্বলচন্দর কি সে জাতের নাকি? তার কাকা বলে বসল—সে চাঁদে গেছে, তার নাকি ছেলেবেলা থেকেই চাঁদে যাওয়ার ন্যাক আছে একটা। এসব বাজে কথা কে কবে শুনেছে? তারপরে ল্যাঠার পর ল্যাঠা! কোত্থেকে কান ঘেঁষে এক আমের আঁঠি, একটা যাচ্ছেতাই ছড়া—চাঁদনির বাজার, শেয়ালপুকুর, পাটকেলানন্দ, মা নেংটীশ্বরী, ঝোল্লা-গোঁফ চক্রধর সামন্তবাদুড়ের নাম অবকাশঞ্জিনীধুত্তোর, কোনও মানে হয় এসবের?
এতেও শেষ নয়। এখন আবার ঘাড়ে চড়াও হয়েছে এক তালঢ্যাঙা বিবেন। আবার তার সঙ্গে রবিবারে মহিষাদলে যেতে হবে। মহিষাদল নামটাই যেন কী রকম—শুনলেই মনে হয় একদল বুনো মোষ শিং বাগিয়ে তাড়া করে আসছে। কপালে কী আছে, কে জানে। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর আমাদের কোন্ চাঁদে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে—তাই বা কে বলতে পারে।
তারপর আবার কী সব রসিদ-ফসিদের কথাও বলছি চক্রধর। তার মানে, অনেক গণ্ডগোল আছে ভেতরে। ক্যাবলা সমানে তো টিকটিক করছে, কিন্তু মহিষাদলের মোষদের পাল্লায় পড়ে–
আমি আর হাবুল সেন এসব নিয়ে অনেক গবেষণা করলুম।
হাবুল ভেবে-চিন্তে বললে, সত্য কইছিস প্যালা। আমরা ফ্যাচাঙে পড়ম।
আমি বললুম, পেছনে আবার পুলিশ আছে ওদের। কী করছে লোকগুলো কে জানে। শেষকালে আমাদের সুষ্ঠু ধরে নিয়ে যাবে।
হাবুল—তা লইয়া যাইব। লইয়া গিয়া রাম-পিটানি দিব।