এরই মধ্যে শুনতে পেলুম, টেনিদা তোতলা হয়ে বলতে লাগল : পুল পুল পুলিশ—
তাই শুনে লোকটা উচ্চিংড়ের মতো ভেংচি কেটে বললে, ডোন্ট বি ফুলিশ। বললুম, তো সাড়া কিছু করো না—তা হলেই আর টের পাবে না। আজই তো আর প্রথম নয়, এর আগে আরও তিন-চারবার তো ম্যাও ম্যাও এসে গেছে, কিন্তু ধরতে পেরেছে কাউকে? নেংটি ইঁদুর একবার গর্তে ঢুকলে বেড়াল কিছু করতে পারে তার? এটা হল মা নেংটীশ্বরীর গর্ত, যতক্ষণ এখানে আছ—ততক্ষণ ওই যে ইংরেজিতে কী বলে—একেবারে সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি।
এর ভেতরে ক্যাবলা পণ্ডিতি করবার লোভ সামলাতে পারল না। টিকটিক করে বলতে লাগল : আজ্ঞে ভুল করছেন। ওটা সাউন্ড এন্ড ফিউরি নয়—সেফ অ্যান্ড সাউন্ড।
তাই শুনে লোকটার মুখ ঠিক একটা ছারপোকার মতো হিংস্র হয়ে গেল। বললে, তুমি থামো হে ছোকরা, বেশি পণ্ডিতি করো না। চল্লিশ বছর এই সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি দিয়ে চালিয়ে দিলুম, তুমি এসেছ ওস্তাদি করতে। বেশি বকিয়ো না এখন, বাইরে শত্রু ঝাঁ করে হয়তোবা কান ধরেই পেঁচিয়ে দেব তোমার।
ক্যাবলা রেগে ঠিক একটা টোমাটোর মতো রাঙা হয়ে গেল, তারপর কী একটা গোঁ-গোঁ। করে উঠেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাবলার পণ্ডিতি আমরা অবশ্য কেউই পছন্দ করি না, কিন্তু তাই বলে বাইরের একটা উটকো লোক এসে তার কান ধরতে চাইবে—সে স্কলারশিপ-পাওয়া কলেজের ছাত্র, এ-ও তো আমাদের পটলডাঙার একটা জ্বালাময়ী অপমান।
যা ভেবেছি তাই আমাদের লিডার টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে গাঁ গাঁ করে উঠল।
-কী বলছেন মশাই, কান ধরে পেঁচিয়ে দেবেন। আমরা পটলডাঙার ছেলে-খেয়াল রাখবেন সেটা। হয় আপনার কথা উইথড্র করুন, নইলে এগিয়ে আসুন—হয়ে যাক এক হাত।
লোকটা বোধহয় এতটা আশা করেনি, কীরকম ভেবড়ে গেল কথাটা শুনে। একটু আগেই আমি অজ্ঞান হব হব ভাবছিলুম, এখন মনে হল মারামারিটা না দেখে অজ্ঞান হবার কোনও মানেই হয় না। চোখকান খুলে খুব খুশি হয়ে দেখতে পেলুম, টেনিদা আস্তিন গোটাচ্ছে।
–শিগগির উইথড্র করুন বলছি, নইলে–
লোকটা তালগাছের মত ঢ্যাঙা হলে কী হয়, বেজায় কাপুরুষ। আড়চোখে টেনিদার চওড়া চিতনো বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। তারপর বললে, আহা—যেতে দাও, মানে বাইরে পুলিশ, এখন আত্মকলহ করে দরকার নেই। গোলমাল শুনলেই টের পেয়ে যাবে। তার চেয়ে এসোসরি বলে ফেলা যাক। ওই যে ইংরেজীতে কী বলে–ফরফিট অ্যান্ড ফরগেট–
ক্যাবলা বললে, উঁহু, আবার ভুল। ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট।
লোকটার মুখ আবার একটা ছারপোকার মুখের মতো হিংস্র হতে যাচ্ছিল, কিন্তু টেনিদার আস্তিনের দিকে তাকিয়ে কী রকম বিবর্ণ হয়ে গেল, তার মুখটাকে ফড়িংয়ের মুখের মতো মনে হল এখন। সে কেমন যেন পিঁপড়ে-পিঁপড়ে গলায় চু চু করে বললে, আচ্ছা-আচ্ছা, তাই হল, ফরগিভ অ্যান্ড ফরফিট।
-আবার ভুল করলেন। ফরফিট, নয় ফরগেট।
-তাই হবে, ফরগেট। আমি উইথড্র করলুম। ওহে ছোকরা, তুমি আর আস্তিনফাস্তিন গুটিয়ো না। ওদিকে বাইরে পুলিশ, এদিকে আবার হার্ট খারাপ, এর মধ্যে তুমি আবার যদি দুড়দুম করে আমাকে ঘুষি লাগিয়ে দাও—তা হলে আর আমি বাঁচব না।
টেনিদা খুশি হয়ে বললে, বেশ আসুন, হ্যান্ডশেক করি। ভাব হয়ে যাক।
-হ্যান্ডশেক? লোকটা সন্দেহে মিটমিটে চোখে চেয়ে রইল : শেষকালে পাঞ্জা ধরে আঙুল-টাঙুল ভেঙে দেবে না তো? আমার শরীর ভালো নয়, সে আগেই বলে রাখছি।
টেনিদা বললে, নানা, কোনও ভয় নেই আপনার। মা কালী, মা নেংটীশ্বরীর দিব্যি, আপনার আঙুলে চাপ দেব না নিন—আসুন হা ড়ু ড়ু—
লোকটা বললে, হা-ড়ু ড়ু? আমি তো কপাটি খেলিনি। আমি—
কিন্তু কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বাইরে থেকে পরপর কয়েকটা জোরাল চিচির আওয়াজ উঠল। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বলল, জয়গুরু লাইন ক্লিয়ার। ম্যাও ম্যাও চলে গেছে!
ঘড়ঘড়িয়ে দরজাটা খুলে গেল। যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলুম আমরা। সব ভুলে-টুলে গিয়ে টেনিদা গলা খুলে চেঁচিয়ে উঠল : ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—
সঙ্গে সঙ্গে আমরা বললাম, ইয়াক-ইয়াক।
লোকটা খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল—এবার ঠিক আরশোলার মতো হয়ে গেল ওর মুখটা।কী বলে তোমরা চেঁচালে?
—ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—ইয়াক-ইয়াক আমি জবাব দিলুম।
—মানে কী ওর?
হাবুল সেন বললে, এটা হৈল ফরাসী ভাষা। মানেটা হৈল গিয়া বড়ই কঠিন।
লোকটা পিপির করে বললে, তাই দেখছি। কিন্তু যাই বলো বাপু তোমাদের হালচাল আমি বুঝতে পারছি না। তোমরা কোন্ ব্রাঞ্চ থেকে আসছ? চট না চিটেগুড়? সঞ্চি না ধুচনি?
আমরা আর কেউ কিছু বলববার আগেই ফস করে ক্যাবলা বললে, কম্বল।
-কম্বল? লোকটা ভুরু কোষ্ঠকাল : বুঝেছি, কোনও নতুন ব্রাঞ্চ হবে। কিন্তু এখনও ওসম্বন্ধে আমরা কোনও খবর পাইনি। যাই হোক, ছড়া যখন জানো আর চাঁদনি পর্যন্তও গেছ তখন চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের কাছেই এবার চলল। তার পারমিট পেলে তখনই ছল ছল খালের জল পেরুতে পারবে। আর ঘর থেকে বেরুবার আগে আরও একবার মা নেংটীশ্বরীকে প্রণাম করো, তিনি সব সিদ্ধি দেবেন।
আমরা আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললুম, জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়।
০৭. সেই তালঢ্যাঙা লোকটার সঙ্গে
সেই তালঢ্যাঙা লোকটার সঙ্গে আমরা গুটি গুটি পায়ে বেরোলুম নেংটীশ্বরীর মন্দির থেকে। লোকটা বলল, এবার হাওয়া মহল। এই ডানদিকের সিঁড়ি।