আমি বললুম, বাবা বিটকেলানন্দ এখানে আছেন?
লোকটা আরও ব্যাজার হল : থাকতেই তো চেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাও ম্যাও।
–ম্যাও ম্যাও।
—আবার কী?—ওরা কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল, বলে কিনা, বাবা চোর, বাবা কালোবাজারী! সইবে না সইবে না!ভীষণ চটে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল : বাবা যোগবলে জেলের গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসবেন। আর যে হাকিম তাঁকে জেলে দিয়েছে–
টেনিদা বললে, তাঁর কী হবে?
-কী হবে?—দাঁত কিড়মিড় করে লোকটা বলতে লাগল : রাত্তিরে যখন সে ঘুমুবে, তখন মা নেংটীশ্বরী দল বেঁধে গিয়ে তার ভুঁড়ি ফুটো করে দেবে। নির্ঘাত দেখে নিয়ো।
বলতে বলতেই–
হঠাৎ কোত্থেকে বিকট গলায় বিশটা হুলো বিড়াল এক সঙ্গে ডেকে উঠল : ম্যাও—ম্যাও—ম্যাও–
আর দারুণ চমকে উঠল লোকটা।
-লুকোও—লুকোও–লুকোও। বাঁচতে চাও তো এখুনি লুকোও। না হলে—
ঘরঘর শব্দে মা নেংটীশ্বরীর মন্দিরের দরজা বন্ধ হল, সেই তালঢ্যাঙা লোকটা জালে-পড়া গলদা চিংড়ির মতো ছটফটিয়ে উঠল, নেংটীশ্বরীর চোখ দুটো ঘরের সেই নানা রঙের আলোতে ঝকঝক করে জ্বলতে লাগল, কেমন যেন মনে হতে লাগল—মা আলোর দিকে কটমটিয়ে চেয়ে রয়েছেন, এখুনি ইকিখি বলে তেড়ে কামড়াতে আসবেন। তার উপরে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়া বিচ্ছিরি গুমট গরমে আমরা সিদ্ধ হচ্ছিলুম-কেমন একটা বদখত গন্ধ আসছিল। একবার মনে হল ওটা নেংটি ইঁদুরের, তার পরেই মনে হল, না চামচিকের গন্ধ।
একেবারে বেকুব বনে গিয়ে আমরা চার মূর্তি—আলু সেদ্ধর মতো চারটে মুখ করে—এ ওর দিকে চেয়ে রইলুম। আর টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে একবার চুলকে নিয়ে বললে, হুঁ, পুঁদিচ্চেরি।
লোকটা কী রকম চমকে গেল। বললে, পুঁদিচ্চেরি! সে আবার কী?
হাবুল বললে, ওটা হৈল গিয়া ফরাসী ভাষা। তার মানে হৈল, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক হইয়া উঠছে।
তালঢ্যাঙা লোকটা তাই শুনে এমন ব্যাজার হয়ে গেল যে মনে হল, এক্ষুনি কেউ তাকে জোর করে একমুঠো নিমপাতা খাইয়ে দিয়েছে। সে বললে, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ফরাসী ভাষা বলো আর যাই বলো—ফিসফিসিয়ে বলবে। শুনলে না—ম্যাও ম্যাও এসেছে? যদিও এ-ঘরে ঢুকতে পারবে না—আর ঘরটা কী বলে এমন কায়দায় তৈরি যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এখানে ঘর আছে, তবু সাবধানের বিনাশ নেই–বুঝতে পারছ না?
আমি বললুম, আজ্ঞে সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু ম্যাও ম্যাওটা—
ক্যাবলা আমাকে একটা চিমটি কাটল, কিন্তু যখন বলেই ফেলেছি, তখন কথাটা আর সামলে নেওয়া যায় না। লোকটা আশ্চর্য হয়ে বললে, কেন, ম্যাও ম্যাও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা নেংটি ইঁদুরের শত্রু কে?
হাবুল বুদ্ধি করে বললে, মানুষ।
—উঁহু হল না।—লোকটা হ-য-ব-র-ল-র কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো মাথা নেড়ে বললে, হয়নি, ফেল। তোমার মগজে দেখছি কিছু নেই।
ক্যাবলা বললে, আজ্ঞে না, সেই জন্যেই তো ওর নাম হাবলা। নেংটি ইঁদুরের শত্রু হচ্ছে বেড়াল।
—ইয়া, রাইট। তা হলে মা নেংটীশ্বরীর শত্রু কে হতে পারে?
ক্যাবলা বললে, পুলিশ।
-ঠিক, একদম করেকট। এইবার বুঝতে পারছ তো? আজ্ঞায় পুলিশ হানা দিয়েছে। ধরতে যদি পারে আমাদের সকলকে একেবারে সোজা শ্রীঘর।
—শ্রীঘর?—টেনিদা খাবি খেয়ে বললে, মানে জেল?
লোকটা ঠোঁটে আঙুল দিলে।
—স্-স্-স্। তোমার তো দেখছি একেবারে হাঁড়িচাঁচার মতো গলা হে। একটু আস্তে কথা বলতে পারো না? তা ভেবেছ কী? পুলিশে একবার ধরতে পারলে তোমায় কি নেমন্তন্ন করে পোলাও-কালিয়া খাওয়াবে? একেবারে তিনটি বছর ঘানিগাছে ঘুরিয়ে দেবে—খেয়াল থাকে যেন।
টেনিদা ধুপ করে সেই চামচিকের গন্ধভরা মেঝেটার উপরে বসে পড়ল, আমার পেটের ভেতরে পিলে-টিলেগুলো যেন কী রকম তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল, হাবুল মুখটাকে ফাঁক করে এমন ভাবে চেয়ে রইল যে, মনে হল, সে এখুনি হাঁউ-মাউ করে ড়ুকরে কেঁদে উঠবে। এ আবার কী ঝঞ্ঝাটে পড়া গেল রে বাপু। সেই উনপাঁজুরে বিশ্ববখাটে কম্বলকে খুঁজতে এসে শেষে জেল খাটতে হবে কে জানে কোন্ চুরি বাটপাড়ির দায়েই জেল খাটতে হবে! আগে একটুখানি বুঝতে পারলেও কে এমন ফ্যাচাঙের মধ্যে পা বাড়িয়ে দিত। কিংবা আমাদের গোড়াতেই বোঝা উচিত ছিল—টেনিদার নাক বরাবর পচা আমটা যখন শত্রুর অদৃশ্য আক্রমণ থেকে ছুটে এসেছিল—সেই তখন।
আসলে, সব দোষ ক্যাবলার। ও-ই তো কী রকম বক্তৃতা দিয়ে আমাদের উত্তেজিত করে দিলে। মনে হল, নিরুদ্দেশ কম্বলকে খুঁজে বের করার মতন মহৎ কাজ দুনিয়ায় আর বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। আমার একটা ভীষণ জিঘাংসা জাগল, ইচ্ছে করল, ক্যাবলার গায়ে কয়েকটা লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দিই, কয়েকটা বিছুটির পাতা ঘষে দিই ওর পায়ে। কিন্তু এখানে লাল পিঁপড়েও নেই, বিছুটিও নেই। এখন কেবল পুলিশের হাতে পড়া, তারপর জেল খাটতে যাওয়া।
জেল খাটতেও নয় রাজি আছি, কিন্তু জেল থেকে বেরুবার পর? বড়দা কি পিঠের একফালি চামড়া বাকি রাখবে? কিংবা জেলে যাওয়ার আগেই এসে এমন ধড়াধধম্ পিটুনি লাগিয়ে যাবে তাতেই ছমাস কাটাতে হবে হাসপাতালে।
আমার চোখের সামনে সর্ষের ফুল-টুল কী সব দুলতে লাগল। যেন দেখতে পেলুম, মা নেংটীশ্বরী মুখটা একটুখানি ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচুচ্ছেন, তাঁর বাঁকা লেজটা যেন অল্প অল্প নড়ছে মনে হল, আমি যেন এখুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ব, আমার দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে।